শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর এক দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের মুখে পড়েছেন। একাধিকবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা, সচিবালয়, শাহবাগ, কাকরাইলসহ রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
ভোগান্তি নিরসনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে সচিবালয়, যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও আন্দোলনকারীরা তা মানছে না। নিষিদ্ধ স্থানেই বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কতটা সফলতার মুখ দেখছে ডিএমপির দেওয়া গণবিজ্ঞপ্তি।
- আরও পড়ুন
- শাহবাগ-কাকরাইলে সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজটে ভোগান্তিতে নগরবাসী
- সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ নিষিদ্ধ
- যমুনায় যাওয়ার চেষ্টা, শিক্ষকদের ওপর পুলিশের জলকামান, লাঠিপেটা
- শ্যামলীতে ব্লকেড, দীর্ঘ যানজটে চরম ভোগান্তি
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে গত সপ্তাহে নগর ভবন, কাকরাইল মসজিদের সামনে ও মৎস্য ভবন মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
রাজধানীতে প্রায়ই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হচ্ছে লোকজনকে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফাইল ছবি: জাগো নিউজ
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে শাহবাগ মোড় এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
এর আগের সপ্তাহে ডিপ্লোমাকে ডিগ্রির মান দেওয়ার দাবিতে শাহবাগে নার্সিং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে কাকরাইলে ‘লংমার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি পালন করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় অবরোধ ও যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
- আরও পড়ুন
- আ’লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত শাহবাগ ছাড়বেন না আন্দোলনকারীরা
- আন্দোলন-জলাবদ্ধতা-যানজটে ‘অচল ঢাকা’, হাঁটারও উপায় নেই
- সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে শাহবাগ-ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড় অবরোধ
- অহেতুক সড়ক অবরোধ না করতে ডিএমপির অনুরোধ
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থান অবরোধের কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। গণপরিবহনে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে জানান যাত্রীরা। অনেককে গণপরিবহন থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে।
রাজধানীতে প্রায়ই সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হচ্ছে লোকজনকে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফাইল ছবি: জাগো নিউজ
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিন এভাবে সড়ক অবরোধের কারণে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কাজে এলেও দিন শেষে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। ফলে বাসের মালিককে খরচের টাকা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
গুলিস্তান থেকে মিরপুরগামী যাত্রী মবিনুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে একই স্থানে বাসে বসে আছি। চাকা ঘুরছেই না। এত যানজট যে নেমে হেঁটে সামনে গিয়ে গাড়িতে উঠবো সেই উপায়ও নেই। পুরা রোড বন্ধ, কোনো গাড়িই যাতায়াত করতে পারছে না।’
- আরও পড়ুন
- কাকরাইলে চলছে জবির আন্দোলন, বাসভর্তি করে আসছেন শিক্ষার্থীরা
- বৃষ্টিতে ভিজে শাহবাগে আন্দোলন করছেন নার্সিং শিক্ষার্থীরা
- সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ ছাত্রদলের
- নগর ভবনে ব্লকেড কর্মসূচি ইশরাক সমর্থকদের, নাগরিক ভোগান্তি চরমে
শাহবাগ থেকে হেঁটে পল্টনের দিকে যাচ্ছিলেন মো. রশিদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিটা দিন আন্দোলন আর সড়ক অবরোধ ভালো লাগে না। এভাবে কি রাস্তায় চলাচল করা যায়? যেদিনই আন্দোলন হয় সেদিনই ঠিক টাইমে অফিসে যেতে পারি না। এভাবে প্রতিটা দিন যদি আন্দোলন আর রাস্তা বন্ধ করা হয় তাহলে আমরা কীভাবে চাকরি করবো?’
যানজটে আটকে ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে মাত্র একটা ভাড়া মারতে পেরেছি। তারপর থেকেই যানজটে আটকে আছি। সারাদিন যদি এভাবে যানজটে আটকে থাকতে হয় তাহলে মালিককে গাড়ির টাকা দেবো কীভাবে আর নিজের পরিবারের খরচ তুলবো কীভাবে।’
গাবতলী লিংক পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী আবির বলেন, ‘প্রতিটা দিন রোডে বের হলেই আন্দোলনে আটকা পড়তে হয়। একটা দিন তো ঠিকমতো গাড়ি চালাতে পারি না। সারাদিন এভাবে আটকে থেকে দিন শেষে মালিককে দেওয়ার টাকা হয় না। আমাদেরও তো পরিবার আছে। আমরা কীভাবে চলবো?’
রাজধানীর ৬০ ফিট এলাকা থেকে পল্টন যাওয়ার উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে সকাল ৯টায় বের হন বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। দুপুর ১টার দিকে তিনি পৌঁছান পল্টনে।
- আরও পড়ুন
- কথায় কথায় সড়ক অবরোধ, নিজেদের পদক্ষেপ জানালো সেনাবাহিনী
- পিএসসিতে চাকরিপ্রার্থীদের ‘ব্লকেড’, সেনাবাহিনীর ধাওয়া
- শাহবাগ মোড় অবরোধ করে ছাত্রদলের বিক্ষোভ
- মার্চ টু যমুনা: পুলিশের বাধায় কাকরাইল মোড়ে অবস্থান শ্রমিকদের
আব্দুল্লাহ আল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এভাবে আর কতদিন চলবে? আমাদের মতো মানুষের কথা কেউ কখনো শুনেছে? কোনো সরকারই আমাদের কথা শোনেনি। রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন আর কতদিন চলবে বলতে পারেন কেউ? আমার মতো চাকরিজীবীদের যদি তিন-চার ঘণ্টা পরে অফিসে যেতে হয় তাহলে কীভাবে চাকরি থাকবে?’
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ হিসেবে বর্তমান সরকার ‘অতি মানবাধিকার বোধসম্পন্ন একটি সরকার’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আন্দোলনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকেরা।
নিষিদ্ধ স্থানে বারবার সভা-সমাবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আন্দোলনকারীদের বারবার অনুরোধ করছি তারা যেন নিষিদ্ধ স্থানে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে। সবাইকে একটু সহনশীল এবং সংযত আচরণ করার জন্য আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি।’
- আরও পড়ুন
- উপদেষ্টা আসিফের পদত্যাগ দাবিতে স্লোগানে উত্তাল কাকরাইল
- বৃষ্টি উপেক্ষা করে আন্দোলনে অনড় জবি শিক্ষার্থীরা
গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেও নিষিদ্ধ স্থানে আন্দোলন কমানো যাচ্ছে না। ফলে জনভোগান্তিও সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হকের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সরকার কিন্তু প্রথম থেকেই দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আগে মানুষ বলতে পারতো না, এখন মানুষ বলছে। যেহেতু সরকার এটাকে সমর্থন জানিয়েছে সুতরাং এখন সবার সমাবেশ বন্ধের বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এটা বন্ধ করার মতো অবস্থা নেই। বাস্তব অবস্থা যা, আন্দোলন এখন চলতেই থাকবে। এই আন্দোলনগুলো চললেও শুরুতেই একটা সমর্থন বা সিদ্ধান্তগত ভুল ছিল। এই দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে যদি কেউ জনভোগান্তি সৃষ্টি করে তাহলে সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বা সরকার কী করবে? খুব একটা বেশি কিছু করার কিছু নেই। কারণটা হচ্ছে এই ধরনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ বা সহযোগিতা কিংবা শৃঙ্খলা বাহিনীর সব সদস্যর মধ্যে যে সমন্বয়ের একটা যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ঘাটতিটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা দৃশ্যমান।’
তৌহিদুল হক বলেন, এসব আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের উদ্দেশ্য এবং তারা কী চায় সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের খুঁজে বের করতে হবে। দেখা গেলো আন্দোলন করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল কিন্তু সবাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলবে। তখন বাহিনীর মধ্যে আবার নতুন করে অস্বস্তি সৃষ্টি হবে।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে এই দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আন্দোলনে সিদ্ধান্ত কী হবে এবং পুলিশের পরবর্তী নির্দেশনা কী থাকবে। এই দুটো সমন্বয় করে যদি কোনো কাঠামোতে আনা যায় তাহলে হয়তো জনভোগান্তি থেকে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যাবে।
কেআর/এমএমএআর/এমএফএ/জিকেএস