অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল পেয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একইসঙ্গে গণভোটের আড়ালে পতিত, পরাজিত ও পলাতক অপশক্তিকে রাষ্ট্র রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান তিনি।
বুধবার (১২ নভেম্বর) বিকালে রাজধানীর চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান এ সব কথা বলেন।
আলোচনা সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে প্রয়াত জিয়াউর রহমানের কর্মময় জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
তারেক রহমান বলেন, জুলাই সনদে যা অঙ্গীকার করা হয়েছে, যা আমরা সই করে এসেছি, বিএনপি এইসব অঙ্গীকার রক্ষা করবে, রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তবে কোনো রাজনৈতিক দল যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল পেয়ে যা ইচ্ছা তা-ই আদায় করে নিতে চায় কিংবা জনগণের দ্বারা বিএনপির বিজয় ঠেকাতে চায় বা কোনো অপকৌশল গ্রহণ করে। সেটি শেষ পর্যন্ত তাদের নিজেদের জন্যই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে কি না, সে ব্যাপারে তাদের বোধহয় সতর্ক থাকা দরকার।
তিনি বলেন, রাজপথের সঙ্গী যারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করছেন বা করার চেষ্টা করছেন, তাদের প্রতি আহ্বান, দয়া করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করবেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী চক্রান্ত নস্যাৎ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সংঘটিত সিপাহী-জনতার বিপ্লব উপলক্ষে আয়োজিত এই আলোচনায় আমি স্বাধীনতার ঘোষকের একটি কথা আবার উচ্চারণ করতে চাই; সেই কথাটি হচ্ছে, ‘জাতীয় ঐক্য আমাদের শক্তি, বিভাজন আমাদের দুর্বলতা’।
এরপরই তারেক রহমান স্লোগান ধরেন, ‘দিল্লি নয়, পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করেছে। এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা কি একটি রাজনৈতিক দলের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করবে, নাকি দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দেবে।
রাজপথের আন্দোলনের সব সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার সংবিধানে লেখা রয়েছে, ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া। সংবিধানে লেখা থাকলেই সবকিছু কি নিশ্চিত হয়ে যায়? হয়তো হয়ে যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তাই বলে কম-বেশি। আসলে সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতার, প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মানসিকতার, সর্বোপরি প্রয়োজন দেশপ্রেম এবং জাতীয় ঐক্য।
তারেক রহমান বলেন, দেশ এবং জনগণের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জনসমর্থিত দল হওয়া সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য অটুট রাখার ব্যাপারে বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। এটি কথার কথা নয়, এটি প্রমাণিত। দুই এবং দুই যেমন চার হয়, এটিও প্রমাণিত; আবার আমরা যদি কাগজপত্রগুলো দেখি, তাহলে দেখব বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিটি দফা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিএনপি অধিকাংশ পয়েন্টে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। আমাদের বক্তব্য একদম পরিষ্কার।
গণভোট করতে গেলে রাষ্ট্রের বিপুল টাকা অপচয় হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে এবার এক কোটি ১৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আলু উৎপাদন করে খুব সম্ভবত আলুচাষিরা বিপাকে পড়ে গিয়েছেন। কারণ, আলুর যে উৎপাদন খরচ এবং উৎপাদিত আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখতে হবে; প্রতি কেজি আলুর পেছনে খুব সম্ভবত খরচ পড়ছে প্রায় ২৫ থেকে ২৭ টাকার মতো। অথচ আলুচাষিরা কিন্তু এখনো অর্ধেক দামেও উৎপাদিত আলু সম্ভবত বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। আলু চাষ করে আলুচাষিরা এবার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
অপর দিকে আমরা দেখি যে, দু-একটি রাজনৈতিক দলের আবদার মেটাতে গিয়ে কথিত গণভোট যদি করতে হয় রাষ্ট্রকে, তাহলে আলুচাষিদের তিন হাজার কোটি টাকা লোকসানের প্রায় সমপরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখোমুখি এসব আলুচাষিদের কাছে এই সময় গণভোটের চেয়ে মনে হয় আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর ভাবনার জন্য আমি এই প্রসঙ্গটি উপস্থাপন করলাম।
একইভাবে পেঁয়াজের উৎপাদনের বিষয়টিও তুলে ধরে তিনি বলেন, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে গণভোট করার চেয়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণাগার বেশি প্রয়োজন। কিন্তু ওই সব চাষির কথা বলার মতো দেশে কেউ নেই, এটাই দুর্ভাগ্য।
দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, গার্মেন্টস শিল্প বন্ধে বেকার-কর্মহীন শ্রমিকদের দুরাবস্থা, শিক্ষাখাতে দুরবস্থা, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার, সর্বনিম্ন ফলাফল প্রভৃতি বিষয়গুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব বিষয় এখন গণভোটের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
গত কয়েক দিনের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, সর্ব খাতে এই রকম দুরাবস্থা। আমরা দেখছি, নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চাইছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির অর্থ একদিকে নির্বাচন না করে হয়তো রাষ্ট্রের খবরদারির সুযোগ গ্রহণ করা, অপরদিকে রাজনৈতিকভাবে যদি বলতে হয়, পরিষ্কারভাবে পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের পথকে সুগম করে দেওয়া। পলাতক স্বৈরাচারীর সহযোগিতায় গত কয়েক দিনে আমরা দেখছি, খোদ রাজধানী ঢাকায় যেভাবে আগুন-সন্ত্রাস চালিয়েছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির করণীয় সম্পর্কে এটা একটা সতর্কবার্তা হতে পারে।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য দেন এলডিপির প্রেসিডেন্ট অলি আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ডা. জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এএসএম আমানউল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জামায়াতের এহসান মাহবুব জুবায়ের, গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বিএনপির মিজানুর রহমান মিনু, খায়রুল কবির খোকন, কাজী আবুল বাশারসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে এই যে একটা সংকট তৈরি হয়েছে- এটা একটা অপ্রয়োজনীয় সংকট। এই সংকট সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন ছিল না। অত্যন্ত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করা হচ্ছে অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করা, বাংলাদেশের সত্যিকার অর্থে সংস্কারের জন্য যে নির্বাচন হওয়া দরকার- সেই নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা, জনগণের ভবিষ্যতকে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলা। আসুন, আজকে আমরা সবাই এই জায়গা থেকে একমত হয়ে কাজ করি।

3 hours ago
6









English (US) ·