গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ

2 months ago 6

দেশের বড় বড় মোকামে আমের প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। অতিরিক্ত গরমে অধিকাংশ জাতের আম পেকে গেছে একসঙ্গে। লোকসান কমাতে গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১০-১৫ টাকা কমেই ছেড়ে দিচ্ছেন। ঈদের লম্বা ছুটিতে জেলার বাইরে আমের চাহিদাও ছিল কম। ছুটি শেষেও সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ওইসব অঞ্চলে এখন আমের ভরা মৌসুম। চাষি পর্যায়ে এবার আমের দাম গত বছরের তুলনায় বেশ কম। যদিও রাজধানী ঢাকার বাজারে আম বিক্রি হচ্ছে গড়ে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকা। তবে উৎপাদন এলাকাগুলোতে দাম ২০ থেকে ৩০ টাকার ওপরে উঠছে না। কোনো কোনো দিন মোকামে দাম ২০ টাকার নিচেও নেমে যাচ্ছে, তখন লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।

নওগাঁর বদলগাছি এলাকার চাষি ইয়াকুব মিয়া বলেন, ‘এ এলাকার বিখ্যাত ফজলি আমের মণ যাচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পাইকারি, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৬০০ টাকা কম।’

গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ

তিনি বলেন, ‘এবার ঈদের কারণে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। লম্বা ছুটিতে শহরের মানুষ গ্রামে থেকেছে। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর এলাকায় আম পাঠানো যায়নি, চাহিদাও ছিল না। তখন আম পেকেছে, নষ্ট হওয়ার ভয়ে কম দামে বিক্রি করেছি।’

আরও কয়েকজন আম চাষি জানান, আম পেকে গেলে দ্রুত পচন ধরে। ফলে কম দামেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। একদিকে ছুটিতে বেচাবিক্রি ছিল কম, তার মধ্যে প্রচণ্ড গরমে আম দ্রুত পেকেছে ওই সময়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এলাকার আম চাষি ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘এবার আমের ঠিক ভরা মৌসুমে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাই সব আম দ্রুত একসঙ্গে পেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে চাহিদাও কম ছুটির কারণে। যে কারণে বড় লোকসান এড়াতে কম দামেই আম বিক্রি করে দিয়েছি।’

গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ

দেশে এখন আমের একটি বড় বাজার তৈরি হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। এই ছুটির মধ্যে অনলাইনের ক্রেতারাও আমের বাজারে যায়নি। তাদের থেকেও অর্ডার মিলেছে কম।

আম কিনুন ডট কম নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কর্ণধার শ্যামল বিশ্বাস বলেন, ‘এ সময় কুরিয়ারও বন্ধ ছিল। আমাদেরও অর্ডার ছিল না। যে কারণে আমরা বাগান ও মোকামে বড় কোনো অর্ডার দিতে পারিনি। ভরা মৌসুমে এ ছুটির কারণে আমরাও ক্ষতির মুখে পড়েছি।’

আবার মোকামগুলোতে মৌসুমি আম বিক্রেতারাও কম আম কিনতে আসেন ঈদের কারণে। সার্বিকভাবে এ বাজারগুলো ছিল খুব ঢিলেঢালা।

এবার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, গুটি, গোপালভোগ, রানিপছন্দ, লক্ষ্মণভোগ, হিমসাগর বা ক্ষিরশাপাতি এবং ব্যানানা ম্যাঙ্গো ও ল্যাংড়া আম পাড়া শুরু হয়েছে এ পর্যন্ত। ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি আম-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতী সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া কাটিমন ও বারি আম-১১ সারা বছরই পাকা সাপেক্ষ পাড়া যাবে।

গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ

তবে চাষিরা জানান, আগে প্রায় সপ্তাহ ব্যবধানে গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ, হিমসাগর এ ধরনের আম পাকলেও এবার প্রায় একসঙ্গে এগুলো পেকেছে। এছাড়া গরমের কারণে আম্রপালি, ফজলি আম আগেভাগে পাকা শুরু করেছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। উৎপাদন আড়াই লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। অনুকূল পরিবেশ থাকায় আম উৎপাদন বেশি হয়েছে এবার। এ কারণে অন্যবারের তুলনায় আমের দাম কিছুটা কম। তবে ছুটি শেষে দাম বাড়বে বলে আশা করছি।’

চাষিদের লোকসানের মধ্যেও রপ্তানি ইতিবাচক

চাষিদের লোকসানের মধ্যেও এ বছর আম রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে জানা যায় ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প’র তথ্যে। প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ২৪টি দেশে প্রায় সাড়ে ৫০০ টন আম রপ্তানি হয়েছে। আরও দুই মাস ধরে রপ্তানিযোগ্য আম বিদেশে যাবে। তাতে গত বছরের চেয়ে রপ্তানি বেশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

গরম-ঈদের ছুটিতে আম চাষির সর্বনাশ

এবছর থেকে চীনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। গত ২৯ মে ১০ টন আমের একটি চালান চীনে পাঠানো হয়েছে। তার আগে চীনে কখনো আম রপ্তানি হয়নি। এ মৌসুমে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ টন আম রপ্তানি হবে চীনে। এছাড়া ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন এবং কানাডার মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের আম রপ্তানি করা হয়।

এবার প্রায় পাঁচ হাজার টন আম বিদেশে রপ্তানির টার্গেট রয়েছে বলে জানান আরিফুর রহমান।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমের ফলন হয়েছিল ২ লাখ ২ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমিতে ২৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২৭ লাখ ৭ হাজার ৪৫৯ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৫ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, আর উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৩ টন আম।

এদিকে বিগত ৮ বছরে আম রপ্তানির হিসাবে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আম রপ্তানি শুরু হয় মাত্র ৩০৯ টন দিয়ে, যা পাঁচ বছর পর ২০২১-২২ এ এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৫৭ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৯২ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩-২৪ এ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আম রপ্তানি কমে যায়, রপ্তানি হয় ১ হাজার ৩২১ টন আম।

এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article