গর্ভধারণের আগে ফলিক অ্যাসিড, চিকিৎসক ‍কি বলছেন

7 hours ago 3

গর্ভাবস্থায় মায়ের খাদ্যাভ্যাস কেবল তার নিজের জন্যই নয়, গর্ভের শিশুর সুস্থতা ও ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। আর এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানগুলোর একটি হলো ফলিক অ্যাসিড। এটি ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক বিকাশে অপরিহার্য, আবার মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, কিশোরী থেকে শুরু করে প্রজননক্ষম বয়সের প্রতিটি নারীই ফলিক অ্যাসিড গ্রহণের মাধ্যমে নানা জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

তবে আমাদের দেশে অনেক নারীর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় এই সচেতনতার ঘাটতি চোখে পড়ে। যার ফলে মা ও শিশুর জন্য মারাত্মক জটিলতা তৈরি হতে পারে। ফলিক অ্যাসিড সচেতনতা সপ্তাহ উপলক্ষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আমরা কথা বলেছি মার্কস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাদিয়া শারমিন দিবার সঙ্গে।

জাগো নিউজ: ফলিক অ্যাসিড আসলে কী?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: ফলিক অ্যাসিড হচ্ছে ফলেট ভিটামিনের একটি কৃত্রিম রূপ, যা ভিটামিন বি-৯ নামে পরিচিত।

জাগো নিউজ: গর্ভাবস্থায় এর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক গঠন নিশ্চিত করে। পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করলে শিশুর জন্মগত জটিলতা, বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডজনিত ত্রুটি বা ‘নিউরাল টিউব ডিফেক্ট’ হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। তাই সুস্থ সন্তান জন্মদানে গর্ভধারণের আগে থেকেই মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড থাকা অত্যাবশ্যক।

জাগো নিউজ: শুধু গর্ভাবস্থায় নয়, জীবনের কোন ধাপ থেকে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ জরুরি?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: গর্ভাবস্থা ছাড়াও প্রতিদিন একজন মানুষের প্রায় ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা উচিত। তবে গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। এজন্য সাধারণত গর্ভধারণের অন্তত ৩ মাস আগে থেকে শুরু করে গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাস পর্যন্ত ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই নানা জটিলতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জাগো নিউজ: ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে মা ও শিশুর কী কী জটিলতা হতে পারে?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে মা এবং শিশুদু’জনেরই জটিলতা দেখা দিতে পারে। মায়ের ক্ষেত্রে সাধারণত মেগালোব্লাস্টিক অ্যানিমিয়া তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যদিকে শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, যাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইন্ট্রাউটেরাইন গ্রোথ রেস্ট্রিকশন’ বলি। এছাড়া শিশুর জন্মগত কিছু সমস্যা, বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডজনিত ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

জাগো নিউজ: আমাদের দেশে নারীদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা কি এই ঘাটতির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: আমাদের দেশের নারীদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় কিছু সমস্যা রয়েছে। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় আমরা বেশিরভাগ সময় কার্বোহাইড্রেটকেই বেশি গুরুত্ব দেই, অথচ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার কম খাই। যেমন-মুরগি বা খাসির কলিজা, যেগুলোতে প্রচুর আয়রন থাকে, অনেক নারীর খাদ্যতালিকায় তা নিয়মিত থাকে না। আবার সবুজ শাকসবজি, ডাল, ফলমূল-এসব খাবার থেকেও আমরা পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন পাই, কিন্তু সেগুলোও অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। ফলে অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর জন্য জটিলতা তৈরি করতে পারে।

জাগো নিউজ: কোন খাবারগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়? সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে কী সতর্কতা দরকার?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: ফলিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি, যেমন- পালং শাক, শিম, মটরশুঁটি, ব্রকোলি ইত্যাদি। এগুলো নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে শরীর প্রাকৃতিকভাবেই প্রয়োজনীয় ফলিক অ্যাসিড পেতে পারে।

সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি। কারণ শরীরে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতি বা চাহিদা ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণত নির্দিষ্ট মাত্রায় ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ নিরাপদ হলেও অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে ভিটামিন বি-১২ ঘাটতির লক্ষণ আড়াল করে দিতে পারে। তাই কখন থেকে শুরু করতে হবে, কতদিন খেতে হবে এবং কতটা পরিমাণ গ্রহণ করা উচিত-এগুলো শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঠিক করা উচিত।

জাগো নিউজ: গর্ভধারণের আগে থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার পরামর্শ কেন দেওয়া হয়?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: গর্ভধারণের আগে থেকেই ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় মূলত শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করতে। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন-চার সপ্তাহে শিশুর নিউরাল টিউব তৈরি হয়, আর এই সময়ে ফলিক অ্যাসিডের অভাব থাকলে স্পাইনা বিফিডা বা অন্যান্য ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মা গর্ভধারণের আগে থেকে ফলিক অ্যাসিড খেলে এই ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়।

জাগো নিউজ: গ্রাম ও শহরের নারীদের মধ্যে সচেতনতার ফারাক কোথায় দেখেন? প্রচার-প্রচারণায় কী করণীয় বলে মনে করেন?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: গ্রাম ও শহরের নারীদের মধ্যে ফলিক এসিড সম্পর্কে ধারণার পার্থক্য রয়েছে। শহরের নারীরা সাধারণত এই বিষয়ে বেশি জানেন এবং গর্ভধারণের আগে ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকেন। কিন্তু গ্রামের নারীদের মধ্যে এই ধারণা তুলনামূলকভাবে কম এবং প্রচার-প্রচারণার অভাবও রয়েছে। অনেক সময় ৯ মাসের গর্ভাবস্থার চেকআপের সময়ও তারা মাত্র দুইবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন। তাই অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হয় না। এই কারণে, মিডিয়ার ভূমিকা এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি এইগুলো বেশি বেশি প্রচার করে তাহলে গ্রামের নারীরাও ধীরে ধীরে সচেতন হবে।

জাগো নিউজ: ফলিক অ্যাসিড নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো কী কী, যেগুলো ভাঙা জরুরি?
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: ফলিক অ্যাসিড সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা আছে। যেমন-অনেকেই মনে করেন এটা খেলে বমি ভাব হয়, পেট ফোলতে পারে বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তবে এসব সাধারণত গুরুতর নয়। আমরা ধীরে ধীরে শুরু করি প্রথমে এক ট্যাবলেট, পরে দুই ট্যাবলেট-এভাবে দিলে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকে।

জাগো নিউজ: আপনার মূল্যবান পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।
ডা. নাদিয়া শারমিন দিবা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

জেএস/জিকেএস

Read Entire Article