গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে উষ্ণ আবহাওয়া

2 weeks ago 6

হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষার সময় কথা বলছিলেন তৃতীয়বারের মতো গর্ভবতী ২০ বছর বয়সী সাগোবাই। আপাতত তিনি সুস্থ বোধ করছেন। তবে গত কয়েক মাস ধরে যখন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তখন প্রায়ই তার মাথা ঘুরতো এবং শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়তো।

তিনি বলছেন, আগের তুলনায় গরম অনেক বেশি। এই চরম তাপমাত্রা তার এবং অনাগত সন্তানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বলে তার আশঙ্কা।

এই আশঙ্কা খতিয়ে দেখছে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডা. জাই দাস-এর নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৪৫ লাখেরও বেশি নারী ও নবজাতক গর্ভকাল, প্রসব বা প্রসব-পরবর্তী সময়ের জটিলতায় মারা যায়। এর মধ্যে লাখ লাখ মৃত্যুর পেছনে তাপমাত্রাজনিত কারণ ক্রমবর্ধমান ভূমিকা রাখছে।

সাগোবাই হচ্ছেন এমন এক বৃহৎ বৈশ্বিক গবেষণার অংশ, যেখানে এই প্রথম এত বড় পরিসরে খতিয়ে দেখা হচ্ছে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত গরমের প্রভাব। বর্তমানে ৪০০ নারী এতে অংশ নিচ্ছেন এবং আরও প্রায় ৬ হাজার নারীর অংশগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুন>

প্রত্যেক নারীকে গর্ভাবস্থার ১৩তম সপ্তাহের আগেই এই গবেষণায় যুক্ত করা হয়—যখন অনেকে এখনো গর্ভধারণের কথা প্রকাশও করেন না। অংশগ্রহণকারীদের একাধিক শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘ সময়ের আল্ট্রাসাউন্ড, ২৪ ঘণ্টা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণকারী ডিভাইস পরিধান, এমনকি সন্তান জন্মের ৩০ মিনিটের মধ্যে তাদের প্লাসেন্টার নমুনা সংগ্রহের মতো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

সব কিছুই হচ্ছে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে অনেক সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক কিংবা ইন্টারনেট সংযোগই অনুপস্থিত।

তবুও গবেষকরা মনে করছেন, তাদের এই পরিশ্রম সার্থক হবে। এ গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যাবে, কেন উষ্ণ জলবায়ু গর্ভবতী মা ও নবজাতকদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এটি এমন একটি প্রবণতা যা বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশে দৃশ্যমান এবং আগামীতে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের ডা. আনা বোনেল বলেন, সন্দেহ নেই, উষ্ণ তাপমাত্রা বর্তমানে মাতৃস্বাস্থ্যে ইতিবাচক অগ্রগতি থামিয়ে দিচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে এবং তীব্র আবহাওয়া আগের তুলনায় আরও ঘন ঘন ও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। উচ্চ তাপমাত্রা শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্মের ওপর চাপ ফেলে। গরমের সঙ্গে লড়াই করতে শরীরের বাড়তি শ্রম করতে হয়—যা সুস্থ মানুষের জন্যও চাপের, আর গর্ভবতী নারীদের জন্য আরও বিপজ্জনক।

গর্ভকালীন সময়ে নারীদের বিপাকক্রিয়া বাড়ে, যাতে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে—এই অতিরিক্ত বিপাক থেকে শরীরে বেশি উত্তাপ সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে রক্তের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়, যার ফলে হৃদপিণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। পানিশূন্যতা ও অপুষ্টি সহজেই দেখা দেয় এবং মা ও শিশুর উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গর্ভবতী নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কিছুটা দুর্বল থাকে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।

নবজাতকেরাও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে দুর্বল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।

তথ্য যা প্রমাণ করে—তাপমাত্রা বাড়লে বাড়ে সময়ের আগেই প্রসবের ঝুঁকি

যদিও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও গর্ভকালীন জটিলতার মধ্যকার সম্পর্ক অনেক দেরিতে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রথম বৃহৎ গবেষণায় দেখা যায়, ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রীষ্মকালে ৮ বছরে প্রায় ৬০ হাজার জন্মের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়—তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সময়ের আগেই (৩৭ সপ্তাহের আগে) প্রসবের হারও বাড়ে। এই ধরনের প্রি-টার্ম জন্ম থেকেই ১ মাসের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর প্রায় ৪০ শতাংশ ঘটে।

এই সম্পর্ককে এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষণাও সমর্থন করেছে। ২০২৪ সালের একটি বিশ্লেষণে ৬৬টি দেশের ১৯৮টি গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রসবের আগের মাসে তাপমাত্রা গড়ে প্রতি ১ ডিগ্র বেড়ে গেলে প্রি-টার্ম জন্মের সম্ভাবনা প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। তীব্র তাপপ্রবাহ (একটানা দুই বা তার বেশি দিন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি গরম) সময়কালীন প্রসবের ঝুঁকি প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়।

যেহেতু অধিকাংশ গবেষণাই ধনী, শীতল জলবায়ুর দেশে হয়েছে তাই উন্নয়নশীল গরম দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এমএসএম

Read Entire Article