অবরুদ্ধ গাজার তিন দিকে ইসরায়েলের সীমানা। একদিকে সাগর। এই সাগর আর তার মাছ বহু বছর ধরে গাজার মানুষকে টিকিয়ে রেখেছে। ইসরায়েলের অবরোধ, হামলা আর খাদ্যসংকটের মাঝেও সাগরের মাছ কিছুটা হলেও জীবনের জ্বালানি যুগিয়েছে।
পরিবারের জন্য খাবার জোগাতে সমুদ্রের গভীরে ডুব দেন সেলেম আবু আমিরা— স্থানীয়দের কাছে যিনি দ্য বিস্ট নামে পরিচিত।
আবু আমিরা বলেন, মানুষ আমাকে ‘দ্য বিস্ট’ বলে ডাকে কারণ আমি একবার দেড় মিটার লম্বা মাছ ধরেছিলাম। এমন বড় মাছ ধরা খুবই বিরল। তবে সত্যি বলতে, আমি অনেক বড় মাছ ধরেছি।
ডুব দিয়ে মাছ ধরার এই কৌশল তার রক্তে মিশে আছে— ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শেখা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে থাকা এক জীবনরক্ষাকারী দক্ষতা।
যুদ্ধের আগ পর্যন্ত গাজার জেলেরা গভীর সমুদ্রে গিয়ে জাল ফেলতেন, যেখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার প্রায় ১৮ হাজার মানুষ সরাসরি মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাদের পরিবারের সদস্যসহ ১ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবিকা নির্ভর করত এই খাতে।
কিন্তু ইসরায়েলের বিধ্বংসী যুদ্ধ সেই জীবনব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে।
আবু আমিরা বলেন, আমরা আর আগের জায়গায় যেতে পারি না। এখন কেবল তীরের কাছেই মাছ ধরি, যেখানে বড় মাছ পাওয়া যায় না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা চলছে। কিন্তু আমার কোনো জীবিকার উৎস নেই— বসে থেকে সাহায্যের অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
যুদ্ধের আগে গাজার জেলেরা বছরে প্রায় ৪ হাজার ৬০০ টন মাছ ধরতেন, যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিবর্ষণ, গ্রেফতার বা হামলার ঝুঁকি সব সময়ই ছিল।
যুদ্ধ শুরুর পর গত দুই বছরে অধিকাংশ নৌকা ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘে জমা দেওয়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রায় ৬ হাজার জেলের মধ্যে ২০০ জন জেলে বা তাদের সহযোগী নিহত হয়েছেন।
যারা এখনো উপকূলের অল্প দূরত্বে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন, তারাও ইসরায়েলি গুলির মুখে পড়ছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসরায়েল গাজার জলসীমাকে নিষিদ্ধ অঞ্চল ঘোষণা করে— মাছ ধরা, সাঁতার কাটা বা সাগরে যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়।
ফলাফল ভয়াবহ— গাজার মাছ ধরার পরিমাণ ৯৪ শতাংশ কমে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্যের অন্যতম শেষ উৎস।
মাসের পর মাস ঘরছাড়া থাকার পর আবার নিজের ভিটেতে ফিরেছেন সেলেম আবু আমিরা— অস্থির, ক্ষুধার্ত এবং সাগরে ফেরার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ছোট নৌকাটি মেরামত করে তিনি আবার নামতে চান ঢেউয়ের বুকে।
দ্য বিস্ট আবার ডুব দেবেন, বাজারে বিক্রির জন্য মাছের খোঁজে। তার মতো গাজার জেলেদের কাছে সাগর শুধু কর্মক্ষেত্র নয়, এটি তাদের জীবনের শেষ ভরসা।
আবু আমিরা বলেন, আমি আমার এই পেশা সন্তানদের শেখাতে চাই। এটি আনন্দের, এটি আমার শখও। মাছ ধরা মনকে শান্ত করে, আবার জীবিকার পথও খুলে দেয়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে কাটানোর পর সেলেমের ভাগ্যে জোটে কয়েকটি মাছ ও একটি অক্টোপাস— যা তিনি পরিবারের জন্য রাখবেন আর বাকিটা বিক্রি করবেন বাজারে।
গাজার জেলেদের সংগ্রাম এখন আর শুধু টিকে থাকার নয়— এটি শতাব্দী-প্রাচীন সাগরের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার লড়াই, সেই শেষ স্বাধীনতার স্পর্শটুকু আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা।
সূত্র: আল-জাজিরা
এমএসএম

7 hours ago
4









English (US) ·