গোমতীর স্রোত: কতরং
বাউ কোমটা বাতাস যেমন ঘুইয়া ঘুইরা মরে
আমিও সখি লো সেইমতো মরি, বিহনে প্রিয় বন্দরে
সন্ধ্যায় সুশীলার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো অমিত। বাড়িতে প্রবেশ করেই তার একটু অন্য রূপ ঠেকল। বারান্দার এক কোণে একটি প্রদীপ অতি ম্লানভাবে টিপটিপ করছে। প্রদীপশিখাটি একটু উজ্জ্বল করতে গিয়ে সে দেখল তাতে পর্যাপ্ত তেল নেই। ভয় হলো, দুই দিন সে এই বাড়িতে আসেনি, বুঝি-বা এর মধ্যে কিছু একটা ঘটে গিয়েছে। বারান্দার এক পাশে বসে সে নিজ মনে কীসব ভাবতে লাগল। অলক্ষ্যে প্রস্থান করার ইচ্ছে হলেও কিন্তু তা আর হলো না। সুশীলা কীসের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই অমিতকে দেখামাত্র বলে উঠল, তুমি কখন এলে?
থতমত খেয়ে অমিত নিশ্চুপ বসে রইল। সুশীলা বলল, তুমি কেমন আছ?
অমিত রুদ্ধকণ্ঠে বলল, আর ভালো থাকা!
অমিতের দিকে কিছুক্ষণ সুশীলা তাকিয়ে বলল, তোমাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটু চা করে দিই?
অমিত মৃদু হেসে একবার সুশীলার দিকে তাকিয়ে বলল: না, প্রয়োজন নেই।
দুপুরে কিছু খেয়েছ বলে মনে হয় না।
খেয়েছি। তারপর কাতর হয়ে অমিত বলল, সুশীলা...
কী!
আমি পারিনি।
কী পারোনি!
পারিনি পার্থকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনতে।
অমিতের একটু কাছে এসে সুশীলা তার কপালের ওপরের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে নিতে নিতে বলল, আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না এত কিছুর পর ও আমাকে ছেড়ে যেতে পারে। না, বিশ্বাস হয় না।
ভুরু কুঞ্চিত করে অমিত বলল: আমি তোমাকে কীভাবে বোঝাবো, তুমি যার জন্য এতদিন অপেক্ষায় ছিলে, যার সঙ্গে তোমার এত গভীর সম্পর্ক, সে তোমাকে অস্বীকার করছে। সে তোমাকে জীবনসঙ্গী করতে চায় না। পরিতাপের বিষয় এই যে, সে আমার একান্ত বন্ধু।
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। তারপরও ও যতক্ষণ-না আমার সামনে এসে বলছে, ততক্ষণ এই বিষয়টি সত্য নয়। একথা বলে অমিতের গলা জড়িয়ে সুশীলা রুদ্ধাবেগে কেঁদে ফেলল। সে আজ অনেক দিন পর নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। অনেক সহ্য করে আজ ধৈর্যচ্যুত হয়েছে। তাই নিজেকে সামলাতে পারল না। সে কখনো রাগ করে না। রাগ করলে বড় বিষম হয়। যে বড্ড শান্ত, যদি ঝড় ওঠে তখন প্রলয়ংকরী হয়ে ওঠে। তার বুকটা যেন ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।
অমিত সযত্নে তার অশ্রুবিন্দু মুছে দিয়ে বলল, কেন এমন করছ? এইদিন চিরকাল থাকবে না। সুদিন অবশ্যই আসবে।
সুশীলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ঈশ্বরের কৃপায় যেন তা-ই হয়। তবে আমার বিশ্বাস ও আমার কাছে আসবে।
শিষ্টশান্ত সুশীলার জন্য অমিতের ভীষণ ভয় হয়। যদি অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। তাই সত্যই প্রকাশ করা উত্তম। অমিত মলিনমুখে অধোবদনে বলল: সুশীলা, সে আর কখনো আসবে না।
কিছুক্ষণ অমিতের মুখের পানে তাকিয়ে থেকে ঈষৎ মৃদুস্বরে সুশীলা বলল যদি তাই হয়, তাহলে কোনো দিন প্রশ্ন করবো না কেন ও আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
অমিত চমকে উঠল। সুশীলার মুখ ম্লান। বড্ড বিষণ্ণ। ম্লান ও বিষণ্ণ মুখ হওয়া সত্ত্বেও অঙ্গসৌষ্ঠব অতিশয় প্রীতিপদ। গায়ের রং চমৎকার। সুশীলার দিকে তাকিয়ে অমিতের মনে হলো, ক্ষীণ প্রদীপশিখায়ও সুশীলার যে রূপ প্রকাশ পাচ্ছে তা যেন এর আগে কখনো দেখেনি। কিছুক্ষণ মৌন থেকে, ধীরে ধীরে অপ্রস্তুতভাবে বলল: এটা কী বলছ সুশীলা! তুমি কি পার্থের কাছে কিছুই নও। তোমাদের এতদিনের সম্পর্ক তুমি অস্বীকার করতে পারো না।
অমিতের কথায় সুশীলা কিছুটা বিমর্ষ হলো। বলল, তুমিই তো বললে ও আর আসবে না। তাহলে আমি কেন পারব না আমাদের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে? সমস্তই ভাগ্য। ঈশ্বরের এই রকমই ইচ্ছে ছিল। কারও কিছু করণীয় নেই।
সুশীলার মন যে অস্থির তা বুঝতে পারে অমিত। সতর্ক হয়ে যায় সে। বলল: ঈশ্বর ও ভবিতব্যের ওপর সমর্পণ করে বসে থাকলে চলবে না, সুশীলা। ঈশ্বরের কাঁধে দায়টা চাপিয়ে দিলে অবশ্য খানিকটা হালকা হওয়া যায়। তবে এই জাতীয় সান্ত্বনাবাক্য তোমার মুখে মানায় না। তুমি যেমন জানো, তেমনই আমিও জানি, এতদিনের সম্পর্কটা তুমি অস্বীকার করতে পারো না।
এবার চকিতে পার্থের মুখ ভেসে উঠল সুশীলার চোখে। বলল, ও যদি পারে, তাহলে আমি পারব না কেন? ও যদি মনে করে সেই মেয়েটি আমার চেয়ে অনেক ভালো, রূপেগুণে গুণান্বিত; তাহলে আমার কিচ্ছু করার নেই। এটি শুধু ওই নিজে নির্ধারণ করতে পারে। তাই না?
তোমার কি কিছুই করার নেই?
না, আমার কিছুই করার নেই।
তোমার বাকি জীবন...
বাক্যটি শেষ না করেই অমিত থেমে গেল।
সুশীলা জিজ্ঞেস করল, বাকি জীবন কী?
কিছুক্ষণ স্থিরচক্ষে সুশীলার দিকে তাকিয়ে রইল অমিত। সে কী বলতে চাইছে সেটি বুঝতে চেষ্টা করছে। অবশেষে আস্তেধীরে মাথা নেড়ে বলল: না, থাক্।
থাকবে কেন? বলো, আমার আর কী করার আছে? তোমার কি মনে হয় আমি ওর কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বলব—আমাকে বরণ করো, আমাকে গ্রহণ করো। তুমি কি তা-ই চাও?
না, আমি তা চাই না।
ও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায়, তাহলে ওকে ধরে রাখব কোন্ কারণে?
অমিত হকচকিয়ে যায়। তার মাথায় মুহূর্তেই একটি প্রবল অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। তারপর নিজেকে সামলে এবং সুশীলার মনোভাব চকিতে আঁচ করে নিয়ে বলল: তোমার মধ্যে এরকম দৃঢ়তা কী করে আসে, সুশীলা?
কী করে আসে জানো, একটা মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব। যখন তোমাকে কেউ ছুড়ে ফেলে দিতে চায়, তখন তুমি বুঝতে পারবে, তোমার ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যদিও আমি ওকে ভালোবাসি তাই বলে আমার ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিতে পারি না।
ভালোই বলেছ। কিন্তু তোমাদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয়।
সুশীলার মধ্যে এমন অনেক ব্যাপার রয়েছে—সারল্য, জেদ, কর্তৃত্ব, অধিকার বোধ। নিজের ঠোঁটে তর্জনী স্থাপন করে বলল, কষ্ট পাবে কেন? দোষ তো তোমার নয়। ব্যর্থতাও তোমার নয়। আমার অদৃষ্ট, তা তোমাকে বুঝতে হবে। আমাকে আমার মতো করে বাঁচতে দাও। অনুশোচনা করতে দাও।
অমিত চমকে ওঠে। বলল: একজনের জন্য আর-একজনের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, শূন্য হয়ে যাবে, আমি তা মেনে নিতে পারছি না।
সুশীলাও মনের মধ্যে দুই পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছে। দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা কি এত সহজ? অমিতের কথায় তার প্রতি শ্রদ্ধাকর্ষণ বোধ করল সুশীলা। আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে সুশীলা। তার ইচ্ছেশক্তি চিন্তাশক্তি উভয়ই যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য। অদৃষ্ট বলে কি আসলে কিছু আছে? সে ঠিক জানে না।
কাজ থেকে ফিরে মিথুন শুয়ে পড়লেও এক সময় শয্যাত্যাগ করে কিছুক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অমিত ও সুশীলার কথাবার্তা শুনছিল। অবশেষে দরজা খুলে বারান্দায় এসে উপস্থিত হল, বলল: অমিতদা।
অমিত ডাকটা শুনতে পেয়ে বলল, কে?
আমি।
মিথুন?
হ্যাঁ।
কখন ফিরলে?
সন্ধ্যার আগেই।
এতক্ষণ কি ঘুমেছিলে?
বিষণ্ণভাবে মিথুন বলল, হ্যাঁ। খুব ক্লান্তি লাগছিল।
মিথুনের ওপর দৃষ্টি রেখে সুশীলা বলল, লাগবেই তো। সেই সকালে যাস, আর সন্ধ্যায় ফিরিস। শরীরের ওপর দিয়ে কি কম ধকল যায়! যা হাত-মুখ ধুয়ে আয়। খাবার দিচ্ছি। অমিতদাকে নিয়ে তুই খেতে আয়।
রাত্রের আহার সমাপন করে অমিত বাড়ি ফিরে গেল। কিছুক্ষণ এ-ঘরে ও-ঘর করে মিথুন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। পথ ভেঙে গোমতী নদীতটের দিকে এগিয়ে চলল। ছোট ছোট তরঙ্গ-বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে ঝলমল ছলছল করে ঘাতপ্রতিঘাত করে সরে যাচ্ছে, আর পরক্ষণেই ফিরে আসছে—কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে এসব দেখতে লাগল মিথুন। দূরে একটি জেলেনৌকা ছপছপ করে প্রশস্ত গোমতীবক্ষ ভেঙে এগিয়ে আসতে থাকে, মিথুন অন্য মনে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ঘাটের সিঁড়িতে বসে জলে পা ডুবিয়ে, আকাশপানে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।
ঠিক এই সময়, জোছনাধৌত রমেশ চক্রবর্তীর বাঁশবাগানে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে সুকান্ত। দৃষ্টির সীমানায় কিছুই নেই। শুধু আকাশে চাঁদ। চন্দ্রকিরণে চারদিক ধবধব করছে। গ্রামটি সুপ্তনিস্তব্ধ। গ্রামে প্রত্যেক নারী ও পুরুষের নিদ্রিত মুখ সুকান্ত মানসচক্ষে দেখতে লাগল। তবে চন্দ্রার মুখটি তীব্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। চন্দ্রাকে ভোলা অসম্ভব। দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখল, দুইজন মানুষ এদিকে এগিয়ে আসছে। লোক দুটি কে তা স্পষ্টভাবে দেখতে না পারলেও, সুকান্ত বুঝতে পারল, চন্দ্রা ও রবি ভিন্ন আর কেউ নয়। তারা ভিন্ন কেইবা এইসময়ে এখানে আসবে? ওরা কাছে আসতে সুকান্তের আর কোনো সন্দেহ রইল না। রবি কাছে এসে বলল, দিদিকে নিয়ে এসেছি।
সুকান্ত বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ।
রবি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে একটু চিন্তা করে নিল, তারপর বলল: আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে লাভ নেই। সময় অতি অল্প। বাবা যে কোনো সময় চলে আসতে পারে। তাড়াতাড়ি তোমাদের কথাবার্তা শেষ করে নাও। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছি।
এক অদ্ভুত নেশায়, মাদকতায় ভয়হীন চন্দ্রা এগিয়ে আসে সুকান্তের কাছে। সুকান্ত তাকায় চন্দ্রার চোখে, উল্লাসচঞ্চলস্নিগ্ধতায় ভরা চোখ দুটি। জীবনের গভীরতাও। প্রেম ও করুণা উভয়ই খেলে বেড়াচ্ছে। সুকান্ত রহস্যময় আবেশে হারিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত চেতনা দিয়েও যেন সে তার প্রেমিকাকে ধরে রাখতে পারছে না। অবুঝ প্রেম স্নিগ্ধতায় ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুকান্ত হাত বাড়ায়। প্রেমিকের ঈপ্সিত স্পর্শে চিকচিক করে ওঠে চন্দ্রার মুখ—স্বচ্ছন্দে, সানন্দে, নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে। প্রকৃতিও পুলকিত।
সুকান্ত বলল, আজ আমার কী-যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
মাথা নেড়ে চন্দ্রা বলল, হ্যাঁ। চিন্তা করে দেখেছ আমাদের কী হবে?
চিন্তা করেছি বলেই তো দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। তোমার বিপদ না-ডেকে আনার জন্য।
আমার বিপদ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন কী করতে হবে তা-ই বলো।
চলো আমরা পালিয়ে যাই। দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাতি।
পালিয়ে যাব? কেন? পালাতে চাইলে তা আগেই করতাম।
তাছাড়া উপায় কী? তোমার অহংকারী পিতা আমাকে কখনোই মেনে নেবেন না। হয়তো তিনি আমাকে পছন্দ করেন। জাত এক হলেও বিত্তহীন এই আমাকে গ্রহণ করা তার পক্ষে অসম্ভবই বটে।
দ্যাখো, বাবার সম্পর্কে আমার কোনো কিছুই বলার নেই। তার সম্বন্ধে কোনো বিরূপ কথা আমার সহ্য হয় না। তিনি ভালো জানেন। তাকে বিচার করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। ভালোও দেখায় না। তার মতামতকে অগ্রাহ্য করা মানেই আমার পক্ষে গুরুতর অন্যায়।
সুকান্ত হেসে বলল, ভালোই বললে। বিত্ত-গৌরব তোমাকেও তাড়া করছে! মনে হচ্ছে অর্থের আশা পূর্ণ হলে আর কোনো আপত্তি থাকবে না।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে চন্দ্রা পূর্বাপেক্ষা ম্লানভাবে বলল, এতদিনে তুমি আমাকে এ-ই বুঝলে! আমার সম্বন্ধে তোমার এই ধারণা?
সুকান্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, সে অধোবদনে বলল: তোমাকে আমি ভুল বুঝতে চাই না চন্দ্রা, কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি সবকিছুই আমাদের বিপক্ষে। এই ঝোড়ো হাওয়া আমাদের সবকিছুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভয় হয় পাছে পদে পদে বিপদ হয়।
চন্দ্রা কপালে করাঘাত করে বলল, তোমাকে এত অবুঝ হলে চলে না। পার্থের ব্যাপারে আমার চিন্তাধারণা তোমাকে আগেই বলেছি। তারপরও কেন আমাকে নিয়ে তোমার এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব?
সুকান্ত আকুলভাবে বলল, তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে প্রতিনিয়ত দ্বিধায় জর্জরিত করছে। নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না।
দীর্ঘশ্বাস মোচন করে চন্দ্রা বলল, তুমি যতটা ভেবেছ, আমি তার চেয়ে অনেক বেশি ভেবেছি। আমার ওপর ভরসা রাখো। জাত-কুল-কন্যা জাত-কুল-সংসারেই প্রবেশ করবে। বাবাকে আমি রাজি করিয়ে ছাড়ব। নিজেকে নিঃসহায় ভেবো না। মা তো আমাদের পক্ষেই আছেন। তাই তোমার দ্বিধা থাকা নিষ্প্রয়োজন। শুধু অনুরোধ, একটু সময় দাও। আর কথা দাও পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তুমি পুরোপুরি ভুলে যাবে।
সুকান্ত হঠাৎ দূরে সরে এলো। তারপর পেছন ফিরে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে অপদার্থ ভাবছ?
চন্দ্রা দুই পা অগ্রসর হয়ে সুকান্তকে কাছে টেনে নিলো, তারপর ঈষৎ গম্ভীরভাবে বলল: তোমাকে অপদার্থ ভাবব কেন? বরং আমি চাই তুমি আমাকে তোমার মতো করে সাজিয়ে ঘরে তোলো।
সুকান্ত বলল: চন্দ্রা, আমার সঙ্গে পথ চলতে পারবে তো?
মুখে আগ্রহের চিহ্ন ফুটিয়ে চন্দ্রা বলল, অসম্ভবই বা কীসে?
সুকান্ত সম্পূর্ণ হতাশভাবে বলল, কী জানি!
আশা নিয়েই তো মানুষের জীবনপথে যাত্রা। তাছাড়া আর কীইবা আছে! তাই আমি তোমার সঙ্গে পথচলার জন্য তৈরি হয়েছি। উন্মুখ হয়ে রয়েছি। এটা তুমি বোঝো না?
সুকান্ত মৌন মুখে, কাতর নয়নে একবার চন্দ্রাকে দেখে নিয়ে বলল: চন্দ্রা, আমার এই পথচলাটা গন্তব্যহীন। অজানা এই পথে তুমি চলতে পারবে তো? তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া আমার পরম ভাগ্য। তবে তুমি কি অর্থ, পরিবারের মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?
তুমি অস্থির কেন সবকিছুতে? আমি তো কখনো ‘না’ বলিনি। আমার এই রাত্রের অন্ধকারে আসাকে তুমি কী মনে করো?
সুকান্ত ভয়ে ভয়ে, আশা-নিরাশা কণ্ঠে ধারণ করে বলল: তাহলে তুমি কি বলতে চাও যে, তোমার মনে কোনো দ্বিধা নেই, ভয় নেই?
চন্দ্রা এবার গম্ভীর হলো। যথারীতি গম্ভীরভাবেই বলল, দ্বিধা... ভয়...
সুকান্ত কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল, আর ঠিক তখনই রমেশ চক্রবর্তীর কণ্ঠ কানে এসে লাগল।
রমেশ চক্রবর্তী যেন একজনকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, ওখানে কে? এই রাত্রে ওখানে কে?
লোকটা কে, বাঁশবাগান থেকে সুকান্ত চিনতে পারল না। তবে সুকান্ত, চন্দ্রা ও রবি বাঁশবন থেকে নিঃশব্দে উধাও হয়ে গেল। অন্যদিকে, লোকটি বলল, আমি পার্থ।
বিরক্তি গোপন করে রমেশ চক্রবর্তী এগিয়ে এলেন। তারপর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে পার্থের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, এই সময়ে এখানে কেন বাবা?
পার্থ এই বাড়িতে নূতন লোক। এক মুহূর্ত নীরবতা পালন করল। তারপর একটা ক্ষীণ আশা বুকের অভ্যন্তরে সঞ্চয় করে বলল, চন্দ্রার সঙ্গে কথা ছিল। তার সঙ্গে কি দেখা করা যাবে?
রমেশ চক্রবর্তী যা চেয়েছিলেন, পার্থ যা চাইছে—উভয়ের মধ্যে আশ্চর্য ব্যবধান রয়েছে। এই ব্যবধান হয়তো অনিবার্য, তবুও রমেশ চক্রবর্তী খুবই সহজ স্বরে, নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে বললেন: কেন যাবে না, বাবা? তুমি বোসো। আমি চন্দ্রাকে ডেকে দিচ্ছি।
চন্দ্রা ও রবি এরই মধ্যে নিজেদের ঘরে ফিরে এসেছে। রমেশ চক্রবর্তীর ডাকে উভয়ই সাড়া দিলো। রবি ছুটে এলো পার্থকে সাদরে আহ্বান করার জন্য। সঙ্গে নিয়ে এলো মায়ের দেওয়া জলখাবার। রবির শান্ত আচরণে পার্থ অবাক হলো।
কলাপাতা রঙের শাড়ি ও লাল ব্লাউজ পরা চন্দ্রা এসে উপস্থিত হলো পার্থের সামনে। পাথরে মূর্তি ওর চোখে-মুখে কোনো উৎসাহের সৃষ্টি হলো না। চন্দ্রার পেছনে দাঁড়াল রবি দৃষ্টিকটু ঔৎসুক্য নিয়ে। তারপর সে নিঃশব্দে প্রস্থান করল। রবির গমন পথের দিকে তাকিয়ে পার্থ বলল, কেমন আছ?
গাঢ় স্বরে চন্দ্রা বলল, ভালো। একথা বলে খাটে পা ঝুলিয়ে একটু কোনাকুনি বসল। তারপর অনেকটা অনুনয়ের স্বরে বলল, এখানে এলেন কেন?
পার্থ দূর থেকেই উত্তর দিলো, তোমার কাছে এসেছি। বিশেষ প্রয়োজন আছে।
আমার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন!
গভীর বিস্ময় চোখে-মুখে ফুটিয়ে পার্থ বলল, নিশ্চয়ই। সেজন্যই আমি এই রাত্রে ছুটে এসেছি।
ব্যাপারটা চন্দ্রার কাছে অস্বাভাবিক বলেই মনে হলো, তাই একটু অবাক হয়েই বলল: সাংঘাতিক ব্যাপারই বটে!
প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটা জগৎ আছে। এখানে সে স্বাধীন, নির্ভীক। এই জগতের দ্বার-উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা অন্যায়। তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, সুকান্তকে একটু বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তুমি কুলীন বংশের কন্যা। তাই এর চেয়ে আর-কিছু মন্দ হতে পারে না।
ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে চন্দ্রা বলল, চুপ করুন। আমাকে কি আপনার রাস্তার মেয়েমানুষ বলে মনে হয়? আগে নিজের দিকটা ভালো করে দেখে নিন।
মনের গভীরে পার্থ একটু খোঁচা খেলো। চন্দ্রার কথায় তার মুখ থেকে হাসি, উচ্ছ্বাস, আলো সবকিছু বিলীন হয়ে গেল। তাই হাসতে গিয়েও পারল না। বিষাদে আচ্ছন্ন মুখে বলল, তোমাদের অবাধ মেলামেশা কারো কারো নীতি ও রুচিতে বাধতে পারে।
অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ কী! নিজে কি কম করছেন?
পার্থ জানে, চন্দ্রা ভুল কিছুই বলছে না। তারপরও বলল, মানে?
আপনি ও সুশীলাদি সম্বন্ধে অজানা কিছুই নেই। এমন প্রেমিক-প্রেমিকা মনে হয় না, এই অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি আছে।
পার্থ মৃদু হেসে বলল, তাহলে ভালোই হলো। জেনেশুনেই তুমি আমার গলায় মালা দেবে।
বাইরটা যে দেখে, সে কীভাবে ভেতরটা সামলাবে?
ভেতর সামলানোর জন্য তো তুমিই যাচ্ছ। আমাকে ভালো না-বাসলেও আমি তোমার ওপর ভরসা রাখি।
পার্থকে এক ঝলক দেখে নিলো, এক তিক্ত প্রবাহ বয়ে চলল চন্দ্রার সারা শরীরজুড়ে। বলল: ভালোবাসা? এতসব জেনে বিয়ের পর যে-সম্পর্ক তৈরি হবে তাতে কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে না। প্রেম জীবনে একবারই আসে। এই প্রেম হচ্ছে আপনার ও সুশীলাদির ভালোবাসা। তাই আমার সঙ্গে আপনার দাম্পত্যজীবন হয়ে উঠবে প্রেমহীন। প্রেমহীন দাম্পত্যজীবন এক নিষ্ঠুর অভিশাপ।
পার্থ সঙ্গে সঙ্গেই বলল, সুকান্তকে তুমি ভুলে গেছো সেকথা বলতে পারো না। তাকে গভীরভাবে তুমি ভালোবাসো তা আমারও জানা। তাই তাকে তুমি মন থেকে সরাতে পারো, তা বিশ্বাস করি না। ঠিক তেমনই আমিও সুশীলাকে ভুলতে পারি না, তা সত্য, তবুও ওকে ভুলে যাওয়াই উচিত।
চন্দ্রার বুকের ভেতর থেকে একটি দীর্ঘনিশ্বাসের ঝড় উঠল। জীবনকে তার মনে হচ্ছে জলের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক সুদীর্ঘ মরুভূমি। এক বিশুষ্ক, উত্তপ্ত বালুকারাশি। নিজের চোখের জল সেখানে পড়ামাত্র শুকিয়ে যায়। বলল: হয়তো-বা এত ভালোবাসা কিংবা ভুলে-যাওয়া কোনোটাই আমার নেই। আমি আঁকড়ে ধরে আছি অভ্যস্ত জীবনের ছন্দকে, সচেতনভাবে। তাই হয়তো আমার বুকের মধ্যে একটি ‘দুঃখ’ নামের বৃক্ষরোপণ করেছি। যতদিন বেঁচে থাকব এই বৃক্ষ থেকেই দুঃখগুলো কুড়িয়ে নেব। নিজের মতো করে জীবন গড়ার সূত্র বা অনুকূল হাওয়া কিংবা অন্য কোনো অবলম্বন আমার জানা নেই।
পার্থের প্রতি চন্দ্রার মনের শূন্যতা পার্থ ধরতে পারল না, যদিও তার চোখে-মুখে কমনীয়তা ছাড়াও রয়েছে পুরুষোচিত অভিব্যক্তি। বলল: এই দুঃখের অংশীদার কি তুমি আমাকে করতে পারো না?
সুগঠিত শরীরের ও উজ্জ্বল বর্ণের পার্থকে আর-একবার দেখে নিলো চন্দ্রা। যৌবনের উন্মেষলগ্ন তার চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। পুরুষোচিত মাধুর্যে সে ভরপুর, যা প্রত্যেক মেয়ের কাছে কাঙ্ক্ষিত। তবে চন্দ্রার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে পার্থের বোকা ভীতু চাউনি। আত্মনিবেদনের আকুতি তার অবয়বকে নুইয়ে দিয়েছে। চন্দ্রা ঠান্ডা গলায় বলল: আমি জানি, আপনাকে সুশীলাদি অনেক ভালোবাসে। দেবতার মতোই হয়তো আপনাকে সে ভালোবাসতে চায়। আমি না-হয় আপনার ভক্তদের তালিকার বাইরেই রয়ে গেলাম।
পার্থের ভেতরটা দপ করে উঠল। চন্দ্রার এই ক্ষিপ্রতার ধাক্কা সে সহ্য করতে পারল না। ভয়ংকর দিশেহারা লাগছে তাকে। কম্পিত, অপমানিত ও বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে সে কাঁপতে লাগল। কোনো নারী তাকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, সে কখনো ভাবতে পারেনি।
চলবে...
- আগের পর্ব পড়ুন
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৮
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৯
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১০
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১১
এসইউ/এএসএম