বিশ্বের সকল মানুষই তার নিজ নিজ ধর্ম পালন করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে ইসলাম মানুষকে অভিন্ন মানবিক অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। জোর করে কাউকে ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা অথবা বল প্রয়োগ বা করার শিক্ষা আমরা পবিত্র কুরআন ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ থেকে পাই না।
পবিত্র কুরআনই এ ঘোষণা দেয়, বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। পছন্দ মাফিক যে কোনো ধর্মেই তারা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং তাদের পছন্দ মোতাবেক তারা যে কোনো ধর্মেরই অনুসারী হতে পারে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘এবং বল, এটা হচ্ছে তোমার প্রভুর কাছ থেকে আগত সত্য, সে কারণে যে চায়, এতে বিশ্বাস করুক এবং যে চায়, অবিশ্বাস করুক।’ (সুরা আল কাহফ, আয়াত : ২৯)।
ইসলাম হচ্ছে এক সুস্পষ্ট সত্য, যারা এতে বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, তাদেরকে তা করতে দেয়ার কথা বলা হয়েছে এবং যারা এতে বিশ্বাস করতে চায় না, তাদেরকে সেটা অগ্রাহ্য করারও পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। ধর্মের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটাকে পছন্দ করার ব্যাপারে মানুষকে স্বাধীনতা দান করা হয়েছে। ইসলামের এমন কোন অস্ত্র নেই, যা দিয়ে কোন মানুষকে জবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করা যায়।
অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে আচরণের বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা নিয়ে অন্য আরেকটি প্রশ্ন অনেকের মনে পীড়া দেয়। ইসলাম কি মুসলমানদেরকে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা করতে নাকি সম্মান ও দয়া প্রদর্শন করতে শিক্ষা দেয়? এ বিষয়ের ওপর পবিত্র কুরআন প্রচুর পথনির্দেশনা দান করে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বল, হে আহলে কিতাব! আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে সমশিক্ষাপূর্ণ একটি নির্দেশের দিকে এসো-যা হচ্ছে, আমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করি, এবং আমরা তার সাথে আর কাউকেই শরিক করি না, এবং তাকে ছাড়া আমরা আর কাউকেই প্রভু-প্রতিপালক বলে মান্য করি না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৬৪)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘হে যারা ইমান এনেছো, আল্লাহর ব্যাপারে স্থির সংকল্প হও, সাক্ষ্যদানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখো, এবং মানুষের শত্রুতা যেন তোমাদের ন্যায়বিচারহীন কোনো কাজে প্ররোচিত না করে। সর্বদাই ন্যায়পরায়ণ হও, সেটাই হচ্ছে সততার অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮) - মাহমুদ আহমদ
একই বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন, ‘এবং ন্যায়পরায়ণতা ও ধার্মিকতায় পরস্পরকে সাহায্য কর, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘণে পরস্পরকে সাহায্য করোনা।’ (সুরা আল মায়েদা, আয়াত : ২)
এখানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের উল্লেখ করা হয়নি। পবিত্র কুরআন বলে, তোমাদের উচিত, সর্বদাই প্রত্যেক সৎকর্ম ও মহৎ-উদ্দেশ্যের আহ্বানে যোগদান করা, সে আহ্বান যদি কোনো ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা যে কোনো ধর্মের অনুসারী, এমন কি নাস্তিকের তরফ থেকেও আসে, ইসলাম মুসলমানদেরকে এ ধরনের লোকদের আহ্বানে সাড়া দেয়া। তাদের উচিত কেবল সেই কারণটির প্রতিই তাকানো, যে জন্য তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, কে আহ্বান করছে, সেদিকে নয়।
উত্তম আচরণের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন হয় এবং পরকালের জান্নাত নিশ্চিত হয়। যেভাবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মোমেনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে বা অশোভন আচরণ করে, তাকে মহান আল্লাহতায়ালা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তার ব্যবহারের কারণে নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সাওয়াব লাভ করবে’ (সুনানে তিরমিজি)।
মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হলো- মহান আল্লাহতায়ালার ভয় ও সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে তা হলো (মানুষের) মুখ এবং লজ্জাস্থান’ (সুনানে তিরমিজি, হাকিম আল মুসতাদরাক)।
আসলে মুসলমানদেরকে পুনরায় বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হতে হলে, পুরোনো গৌরব ফিরে পেতে হলে সবারই উচিত ধনী-গরীব, জাতি, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও উত্তম ব্যবহার করা।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের জাহেলি যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মুমিন হলো আল্লাহভীরু আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সবাই আদমসন্তান আর আদম (আ.) মাটির তৈরি। মানুষের উচিত বিশেষ গোত্রভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা। (সুনানে আবু দাউদ)
ইসলাম সোনালি এক নীতি নির্ধারণ করেছে, যা সকল মানুষই অনুসরণ করতে সক্ষম এবং তা থেকে সবাই উপকৃত হতে পারে। ইসলাম এ শিক্ষা দান করে যে, সব আচরণের ভিত্তি সর্বদাই ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘হে যারা ইমান এনেছো, আল্লাহর ব্যাপারে স্থির সংকল্প হও, সাক্ষ্যদানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখো, এবং মানুষের শত্রুতা যেন তোমাদের ন্যায়বিচারহীন কোনো কাজে প্ররোচিত না করে। সর্বদাই ন্যায়পরায়ণ হও, সেটাই হচ্ছে সততার অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ অবশ্যই অবগত আছেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৮)
একথা এটাকে পর্যাপ্তভাবে খোলাসা করেছে, ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের ওপর এটা নির্ধারিত করা হয়েছে যে, শত্রুদের সাথেও তারা ন্যায্যতার নিরিখে আচরণ করবে। এমন একটি ধর্ম, যা ঐক্য ও সহযোগিতার অনুপম শিক্ষার বিস্তার ঘটায়, সেই ধর্মের এমন কোনো সম্ভাবনা আছে কি যে, অন্য লোকদের বিরুদ্ধে কখনো সহিংসতা অথবা ঘৃণার বিস্তার ঘটাবে? মানবজাতিকে দেয়া হেদায়াতের চূড়ান্ত বাণী এবং মুক্তির সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপত্রই হলো ‘ইসলাম’। এ ইসলাম শান্তি বই আর কিছুই নয়।
যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার শিক্ষার বিষয়টি মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার লিখনিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি লিখেছেন-
“নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্তান।
নাইকো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গির্জা-ঘর,
নাইকো পাইক-বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।
এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশত, এখানে বিভেদ নাই,
যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই!
নেইকো এখানে ধর্মের ভেদ শাস্ত্রের কোলাহল,
পাদরি-পুরুত-মোল্লা-ভিক্ষু এক গ্লাসে খায় জল।
হেথা স্রষ্টার ভজনা-আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তাঁর দুঃখের সিংহাসন!
সাড়া দেন তিনি এখানে তাহারে যে-নামে যে-কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে-নামে ডাকে সে মাকে!
পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেথা হয় নাকো ঘুঁষোঘুঁষি,
ধুলায় মলিন দুঃখের পোশাকে এখানে সকলে খুশি।”
জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। তাইতো লিখতে পেরেছেন, “গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিষ্টান।”
তিনি লিখেছিলেন “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।”
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুসরণ করে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ থেকে জীবন অতিবাহিত বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/এমএস