ঘোষণায় বছর পার, মিল চালুর উদ্যোগ না পেয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

2 hours ago 5

পাবনা সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধে পাঁচ বছর আগে স্থগিতাদেশ দেয় সরকার। এরপর গতবছরের ১৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় ধাপে মিল চালুর কথা জানায়। তবে সেই ঘোষণার ১১ মাসেও মিল চালুর বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

প্রায় ৫ বছর ধরে বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৮০ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ও মালামাল। মোটা অংকের ঋণের বোঝার পাশাপাশি অলস বসিয়ে নিয়মিত দিতে হচ্ছে কর্মরতদের বেতনভাতা। দ্রুত সব সমস্যা সমাধান করে মিল চালু করার দাবি সংশ্লিষ্টদের।

জানা যায়, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়াতে ৬০ একর জমির ওপর ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থাপন করা হয় পাবনা সুগার মিল। এরপর ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাওয়ার পরের বছর আখ মাড়াই মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে মিলটি। পরে এ কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নেয় মিল কর্তৃপক্ষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদ বাড়তে থাকে সেই ঋণের। বর্তমানে ৫৫৩ কোটি ৬০ লাখ ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। একেতো ঋণের বোঝা, তারওপর অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর মিলটির মাড়াই বা উৎপাদন কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয় সরকার।

ঘোষণায় বছর পার, মিল চালুর উদ্যোগ না পেয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

মিলটির হিসাবরক্ষণ বিভাগ বলছে, উৎপাদন বন্ধের বছরও মিলটি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে। কিন্তু বর্তমানে একেবারেই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ। মিলের কাঁধে বর্তমানে ৫৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা রয়েছে। এ ঋণের সঙ্গে প্রতি বছর গড়ে ৪৫ কোটি টাকা করে সুদ যুক্ত হচ্ছে।

আরও পড়ুন-

আখের অভাবে চালু হচ্ছে না পঞ্চগড় চিনিকল, শ্রমিকদের হাহাকার

আশা জাগাচ্ছে শ্যামপুর চিনিকল, রয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ

ঘোষণাতেই থেমে আছে পাবনা চিনিকল চালুর কার্যক্রম

এছাড়া কোনো উৎপাদন না থাকলেও মিল রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রশাসনিক কাজের জন্য কর্মকর্তা, কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের বেতনভাতা বাবদ প্রতিমাসে প্রায় ১৪-১৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে মিলের। এভাবে শুধু বেতনভাতা বাবদ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ কোটি ৯০ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৩৭ লাখ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ কোটি ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে মিল কর্তৃপক্ষকে।

বর্তমানে মিলের যন্ত্রপাতি ও মালামাল রক্ষার জন্য ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। যাদের মাসিক বেতনভাতা গড় ব্যয় ৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর বাইরে বর্তমানে মিলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ প্রশাসনে ৬, হিসাবরক্ষণ বিভাগে ৬, কারখানা বিভাগে ৩, ইক্ষু বিভাগে ২, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ চতুর্থ শ্রেণির ৫ ও মসজিদের ইমামসহ মোট ২৩ জন কর্মরত রয়েছেন। উৎপাদনের সময় মিলটিতে ১২০০ শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, উৎপাদনের সময় মিলটি কর্মমূখর ছিল। তখন লোকবল বেশি লাগতো। কিন্তু এখন শুধু পরিচ্ছন্নতা ও প্রশাসনিক কাজের জন্য ২৩ জন কর্মরত আছি।

ঘোষণায় বছর পার, মিল চালুর উদ্যোগ না পেয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

সরেজমিনে দেখা যায়, বন্ধের পর মহাসড়কের পাশে সুগার মিলের যে পুরোনো সাইনবোর্ডটি ছিল সেটি পাল্টানো হয়েছে। তবে মিলের ভেতরে গত ৫ বছর ধরে ভূতুড়ে পরিবেশ। আখ সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত ট্রাক, ট্রলিসহ বিভিন্ন যানবাহন সবুজ আগাছায় ঢেকে আছে। মরিচায় একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে এসব যানের যন্ত্রপাতি। গোডাউন ও কারখানার টিনশেড খুলে পড়েছে। কোনোটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঝুলছে। জরাজীর্ণ অবস্থা কংক্রিটের দেয়ালগুলোর। কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতেই সুনসান নীরবতা ঘিরে ধরে। মাড়াই যন্ত্রের ব্রয়লার হাউজ, ক্রাসার, ডোঙ্গা, রুলার, বিয়ারিং ও মোটরসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে। আর বাইরের অংশ ঝোপঝাড়ে ছেয়ে আছে।

কারখানা ঘুরিয়ে দেখান মিলের একজন কর্মচারী। তিনি বলেন, এই যে মাঠে ঝোপঝাড় দেখছেন, এটি এরকম ছিল না। আখবাহী গাড়ি ও মানুষের পদচারণায় ধুলা হয়ে থাকতো। চাষিরা আখ দিয়ে টাকা বুঝে নিয়ে হাসিমুখে ফিরে যেত। কিন্তু মিলটি বন্ধ থাকায় সেসব দৃশ্য আর দেখা যায় না। এখানে কেউ প্রবেশই করে না। বাইরে নিরাপত্তাকর্মীরা পাহারা দেয়।

জানা যায়, ঈশ্বরদীসহ পাবনাকে ৮টি আখ জোনে ভাগ করা ছিল। বেশি আখ চাষ হতো ঈশ্বরদীতেই। পাবনা সুগার মিলের অধীনে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার একর জমিতে সারাবছর আখ চাষ করতেন। কিন্তু মিল বন্ধ হওয়ারর পর অনেক চাষিই আখ চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েও মিল চালুর উদ্যোগ দেখা না যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চাষিরা। লাভজনক পদ্ধতি অবলম্বনে মিল পরিচালনার ব্যবস্থা করে দ্রুত মিল চালুর দাবি তাদের।

পাবনা সুগার মিল আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জাতীয় কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, দ্রুত মিল চালুর ব্যাপারে চাষিদের পক্ষ থেকে শিল্প উপদেষ্টার কাছে আমরা চিঠি দিয়েছি। কিন্তু এর কোনো সাড়া এখনো মেলেনি। আবার ঘোষণার ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও মিল চালুর ব্যাপারে তেমন দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। চাষিরা মিল চালুর ব্যাপারে উন্মুখ হয়ে আছেন। দ্রুত এ সুগার মিলটি চালু করতে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, উৎপাদন বন্ধের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমাদের অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয়নি। কোনো চিঠিও আসেনি। তবে আমরা বিভিন্নভাবে জেনেছি, প্রথম ধাপে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় ধাপে পাবনা ও পঞ্চগড় চিনিকল ও তৃতীয় ধাপে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকল চালু হওয়ার কথা। কিন্তু কবে বা কত সময়ের মধ্যে চালু হতে পারে এ ধরনের কোনো কিছুই আমরা জানি না।

তিনি বলেন, মিলের কার্যক্রম চালুর ঘোষণা দিলেই সেই বছর উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে না। উৎপাদনে যেতে কমপক্ষে দুই বছর লেগে যাবে। কারণ কারখানা চালুর প্রস্তুতি ছাড়াও আখের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এ যোগান নিশ্চিতে দুই বছর সময় লেগে যাবে। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও চাষিরা যেন আখ চাষ একেবারে বন্ধ না করে সে ব্যাপারে আমরা তাদের সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখছি। যতটুকু সম্ভব সহায়তা করছি।

এফএ/জেআইএম

Read Entire Article