সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজ ঘিরে ছিল বেশ আলোচনা। সেই জাহাজে কী এসেছিল তা নিয়েই আলোচনার টেবিল সরগরম ছিল টানা এক সপ্তাহের বেশি সময়। সেই রেশ না কাটতেই ফের পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের সেই জাহাজটি। আগামী ১৯ ডিসেম্বর কনটেইনারবাহী পণ্য নিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার কথা রয়েছে। এ পথে নিয়মিত জাহাজ পরিচালনা করতে মালিকরা আগ্রহী বলেও জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এসব তথ্য কালবেলাকে জানিয়েছেন নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার এবং রেজিস্ট্রার অব বাংলাদেশ শিপস ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ।
জানা যায়, এর আগে গত ১১ নভেম্বর জাহাজটি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। ৩৭০ একক পণ্যবাহী কনটেইনার খালাসের পর জাহাজটি পরদিন চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয়। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের পর করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা প্রথম কোনো জাহাজ। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দুই দেশের মধ্যে নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ শুরু হয়।
নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার এবং রেজিস্ট্রার অব বাংলাদেশ শিপস ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘করাচি, দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন বাণিজ্যিক রুট অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। নতুন এ রুট বাংলাদেশের নৌবাণিজ্যকে আরও এগিয়ে নেবে বলে আশা করছি। আগামী ১৯ ডিসেম্বর ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজটি কনটেইনারবাহী পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে লাইনার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রথমবার গত ১১ নভেম্বর এইচআর শিপিং লাইনের অধীনে ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের জাহাজের মাধ্যমে ৩৭০ একক কনটেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। পরদিন ১২ নভেম্বর কনটেইনার খালাস করে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে। জাহাজটি মূলত দুবাইয়ের ‘জেবল আলী’ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে মধ্যবর্তী করাচি বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। জাহাজটির সাধারণ রাউন্ডিং হচ্ছে দুবাইয়ের জেবল আলী বন্দর থেকে শুরু করে পাকিস্তানের করাচি বন্দর, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর, ইন্দোনেশিয়ার বেলাওয়ান বন্দর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দর, ইন্ডিয়ার মুন্দা বন্দর ঘুরে পুনরায় দুবাইয়ের জেবল আলী বন্দর। জাহাজটি পণ্য নিয়ে মূলত এসব পথে ঘুরবে।’
তিনি বলেন, ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং নামের জাহাজটির প্রকৃত কনটেইনার পরিবহন ক্ষমতা দুই হাজার ৩০০টি। এই রুটে আমদানি কনটেইনার পর্যাপ্ত হলে ভবিষ্যতে রুটটি নিয়মিত পরিচালনা করতে জাহাজ মালিকগণ আগ্রহী হবে। আগে পাকিস্তানের সঙ্গে সিঙ্গাপুর এবং কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো। নতুন রুটটি চালু হওয়ার কারণে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। এতে করে সাশ্রয়ী ব্যয় এবং সময়ে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানিতে নতুনভাবে গতিশীলতা সৃষ্টি হবে।’
কাস্টমসের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে জাহাজটিতে করে সবচেয়ে বেশি আনা হয়েছে সোডিয়াম কার্বনেট বা সোডা অ্যাশ। টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এটি। মোট ১১৫ একক কনটেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য হলো খনিজ পদার্থ ডলোমাইট। ডলোমাইট রয়েছে ৪৬ একক কনটেইনারে। মোট ৩৫ একক কনটেইনারে আমদানি করা হয় চুনাপাথর। ৬ একক কনটেইনারে আনা হয় ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট।
এ ছাড়াও কাচশিল্পের কাঁচামাল ভাঙা কাচ আনা হয়েছে ১০ একক কনটেইনারে। শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড়, রঙ ইত্যাদি রয়েছে ২৮ একক কনটেইনারে। একটি কনটেইনারে রয়েছে গাড়ির যন্ত্রাংশ। এসব পণ্য আমদানি করেছে আকিজ গ্লাস কারখানা, নাসির ফ্লোট গ্লাস, প্যাসিফিক জিনস, এক্স সিরামিকস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ৪২ একক কনটেইনারে আনা হয় পেঁয়াজ। যার পরিমাণ ৬১১ টন।
এর বাইরে ১৪ একক কনটেইনারে আলু আমদানি হয়েছে ২০৩ টন। এই দুটো পণ্য আনা হয়েছে হিমায়িত কনটেইনারে। পেঁয়াজ-আলু এনেছে ঢাকার হাফিজ করপোরেশন, এম আর ট্রেডিংস ও চট্টগ্রামের আল্লাহর রহমত স্টোর।
পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্নধার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘এ সেবা চালুর আগে পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রথমে জাহাজে করে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের বন্দরে আনা হতো চট্টগ্রামমুখী কনটেইনার। পরে এসব বন্দর থেকে চট্টগ্রামমুখী ফিডার জাহাজে তা তুলে দেওয়া হতো। সরাসরি সেবা চালুর পর এখন করাচি থেকে জাহাজে বোঝাই করার পর কোনো বন্দরে ওই কনটেইনার নামানোর দরকার হবে না।’
আরও জানা যায়, সমুদ্রপথে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের বন্দরগুলোর চেয়ে বেশি। সি ডিসট্যান্স ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী—এ দূরত্ব ২ হাজার ৬১২ নটিক্যাল মাইলের বেশি। এ জন্য নতুন সেবা চালু করা দুবাইভিত্তিক কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ফিডার লাইনস ডিএমসিসি’ কয়েকটি দেশের বন্দরকে যুক্ত করেছে। তাদের এই সেবায় যুক্ত জাহাজটি প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে আসবে। এরপর ভারতের মুন্দ্রা, ইন্দোনেশিয়ার বেলাওয়ান ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে।
এদিকে গত ১১ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজটি আসার পর তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলে। জাহাজটিতে আনা পণ্য নিয়ে দেশে-বিদেশে চলে অপপ্রচার।
গত ১৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সভায় এলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই জাহাজ মিডল ইস্ট (মধ্যপ্রাচ্য) থেকে এসেছে। সেখান থেকে এসে একটা দেশে গেছে, সেখান থেকে আমাদের দেশে এসেছে। আমাদের দেশে কোনও দেশের জাহাজ আসা নিষিদ্ধ আছে? আমরা কী কারও কাছে বন্দি যে শুধু তার সেবা করবো? আমার দেশ সবার ওপরে। খেজুর, পেঁয়াজ, আলু—এগুলো সামনের রোজার সময় দরকার। এগুলো কি আমরা আসতে দেব না? যারা এগুলো নিয়ে গুজব রটাচ্ছে, তারা আমাদের শত্রু।’