আরিফুল ইসলাম তামিম
এ যেন অন্যরকম আয়োজন, ভিন্নধর্মী এক মিলনমেলা। স্টলে স্টলে সারি সারি সাজানো আছে হরেক রকম বই।থ্রিলার সিরিজ, উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ, একাডেমিক বই থেকে শুরু করে কী নেই, আছে শিশুতোষ বইও। এত এত বই দেখে মনে হতে পারে এটি কোনো বইয়ের রাজ্য। তবে বেচা-বিক্রির জন্য এসব বই সাজিয়ে রাখা হয়নি। মূলত পঠিত বই জমা দিয়ে বিনা মূল্যে বই বিনিময়ের জন্য রাখা হয়েছে। এমন ব্যতিক্রমী আয়োজনের চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামের বই বিনিময় উৎসবে।
১০ জানুয়ারি নগরীর জামালখানে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টোরিটেলিং প্লাটফর্ম ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের উদ্যোগে দিনব্যাপি ষষ্ঠবারের মতো আয়োজিত হয়েছে ‘বই বিনিময় উৎসব’।বইপোকাদের জন্য অনবদ্য এক খুশির দিন ছিল এটি। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চলে এবারের বই বিনিময় কার্যক্রম। সকাল থেকেই পাঠকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে জামালখানের ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে রাস্তার দু’পাশের স্টলগুলো।
শিশু থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের হাতে ছিল ব্যাগভর্তি বই। এসব বই বিনিময় করে নতুন বই সংগ্রহ করাই ছিল লক্ষ্য। পঠিত বই জমা দিয়ে পছন্দসই নতুন বই নিতে দিনব্যাপি মুখিয়ে ছিলেন বইপ্রেমী জনসাধারণ। ‘বই নয়, জ্ঞানের বিনিময়’ স্লোগানে উৎসবমুখর এ আয়োজনে অংশ নেয় হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষ।
১১টি স্টলে সাজানো হয় বই বিনিময় উৎসব। উৎসবে ভিন্নধর্মী আবহ তৈরি করে জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে আয়োজিত উৎসবের স্টলগুলোর নামও ছিল শহীদদের নাম। নজরুল স্মৃতিতে নজরুল কর্নার। রেজিস্ট্রেশন বুথ দু’টোর নাম শহীদ ওয়াসিম আকরাম ও শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত রাখা হয়েছিল। শিশুতোষ ও ম্যাগাজিন স্টলের নাম রাখা হয় শহীদ রিয়া গোপের নামে।
এ ছাড়া রাজনীতি, আত্মজীবনী ও ইতিহাস স্টলের নাম রাখা হয়েছে শহীদ শহীদুল ইসলাম, একাডেমিক শহীদ রিপন, সমগ্র শহীদ জামাল, কথাসাহিত্য (ক) শহীদ হৃদয় তরুয়া, ক্যারিয়ার ও বিজ্ঞান শহীদ তানভীর সিদ্দিকী, হুমায়ুন আহমেদ শহীদ আহসান হাবীব, কবিতা শহীদ ইউছুফ, কথাসাহিত্য (খ) শহীদ ইসমামুল হক, প্রবন্ধ ও অন্যান্য শহীদ ওমর বিন নুরুল আবসার, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন শহীদ ফরহাদ হোসেনের নামে রাখা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতিও ফুটিয়ে তোলা হয় উৎসবে। শুধু তা-ই নয়, হামাস যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্রও ঠাঁই পেয়েছে আয়োজনে। প্রায় ৩০ হাজার বই বিনিময় হয়েছে উৎসবে। সকাল থেকে বইপোকাদের আগমন দেখা যায় জামালখানে। বিকেল হতেই বইপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়ে ব্যস্ততা বাড়ে স্টলগুলোয়। পছন্দের বই নিতে পেরে খুশি শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী পাঠক।
বই কিনতে প্রয়োজন হয় অর্থ। অর্থের অভাবে অনেকেই পছন্দের বই কিনতে পারেন না। ঘরের কোণে পড়ে থাকা বই বিক্রি করেও তেমন অর্থ পাওয়া যায় না। লাইব্রেরিতেও নেই বই বিনিময়ের সুবিধা। পাঠকদের সার্বিক দিক বিবেচনা ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে সাড়া ফেলেছে বই বিনিময় উৎসব। বই বিনিময়ের মাধ্যমে খুব সহজেই বইপ্রেমীরা পছন্দের বই সংগ্রহ করতে পেরেছেন। তাই পাঠকদের কাছে অন্যতম আনন্দের দিন ছিল এটি।
কেউ বই সংগ্রহ করছেন, কেউ বই সংগ্রহের পাশাপাশি ভিন্নধর্মী উৎসবে নিজেকে ফ্রেমবন্দি করতে ব্যস্ত। আয়োজনকে সুন্দর করতে ব্যস্ত প্রায় অর্ধশত ভলান্টিয়ার। পাঠকদের পছন্দের বইটি খুঁজে দিতে কিংবা বই বিনিময় প্রক্রিয়া বুঝিয়ে দিতে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
এবার বই বিনিময় উৎসবে ছিল দুটি রেজিস্ট্রেশন বুথ। প্রথমে রেজিস্ট্রেশন বুথে বই জমা দিতে হয়। এরপর জমা দেওয়া বইয়ের ক্যাটাগরি অনুযায়ী স্টল নম্বর লিখে দেন ভলান্টিয়ার। সে অনুযায়ী স্টলে গিয়ে পছন্দমতো বই সংগ্রহ করতে পারেন যে কেউ। একাডেমিক বইয়ের ক্যাটাগরি ছাড়া অন্য ক্যাটাগরির যে কোনো ৫টি বই বিনিময় করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবার।
বই বিনিময় উৎসবের দায়িত্বরত ভলান্টিয়ার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজনের সাক্ষী হতে পেরে ভালো লেগেছে। আমি প্রথমবারের মতো এখানে ভলান্টিয়ার হয়েছি। আমার মতো অর্ধশত ভলান্টিয়ার কাজ করেছেন এ আয়োজনে।’
উৎসবের সমন্বয়ক এবং ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজের পরিচালক সাইদ খান সাগর বলেন, ‘এবারের আয়োজন উৎসর্গ করেছি জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি। ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারে জুলাই অভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া নানা স্মৃতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। চট্টগ্রামের বইপ্রেমীদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ছিল। আমরা ষষ্ঠবারের মতো সফলভাবে আয়োজন করতে পেরেছি। আগামীতে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করতে চাই।’
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।
এসইউ/এএসএম