চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে নানান প্রশ্ন
২০২৬ সালের জুনের মধ্যে চলমান র্যাম্পের কাজ শেষ করার তাগিদ পরিপূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করার টাইমফ্রেম নেই সিডিএর নিজস্ব অর্থায়নে আরও র্যাম করার পরিকল্পনা আট বছর পেরোলেও চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটছে। কাজ অর্ধসমাপ্ত করে চব্বিশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয় উড়ালসড়কটি। কাজ এখনো চলমান। ভবিষ্যতে সড়কটির যথাযথ ব্যবহার ও সুফল নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। উড়ালসড়কটি লালখান বাজার থেকে শুরুর কথা থাকলেও লালখান বাজারে মূল সড়ক থেকে সেতুতে ওঠার পথই রাখা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েটিতে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, ওই টাকা দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের বদলে পুরো চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অধিকতর ব্যবহার উপযোগী এবং জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যেত। যার সুফল পুরো নগরবাসী ভোগ করতে পারতো। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী করতে হলে আরও টাকা ব্যয় করতে হবে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরো সুফল আসবে না। শুধু র্যাম্প দিলেই ব্যবহার বাড়বে, তা কিন্তু নয়। ঢাকায়ও র্যাম্প দিয়ে সুফল মেলেনি। এজন্য ট্রাফিক ম্
- ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে চলমান র্যাম্পের কাজ শেষ করার তাগিদ
- পরিপূর্ণ ব্যবহার উপযোগী করার টাইমফ্রেম নেই সিডিএর
- নিজস্ব অর্থায়নে আরও র্যাম করার পরিকল্পনা
আট বছর পেরোলেও চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটছে। কাজ অর্ধসমাপ্ত করে চব্বিশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয় উড়ালসড়কটি। কাজ এখনো চলমান। ভবিষ্যতে সড়কটির যথাযথ ব্যবহার ও সুফল নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন।
উড়ালসড়কটি লালখান বাজার থেকে শুরুর কথা থাকলেও লালখান বাজারে মূল সড়ক থেকে সেতুতে ওঠার পথই রাখা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েটিতে যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে, ওই টাকা দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের বদলে পুরো চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অধিকতর ব্যবহার উপযোগী এবং জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা যেত। যার সুফল পুরো নগরবাসী ভোগ করতে পারতো।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী করতে হলে আরও টাকা ব্যয় করতে হবে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরো সুফল আসবে না। শুধু র্যাম্প দিলেই ব্যবহার বাড়বে, তা কিন্তু নয়। ঢাকায়ও র্যাম্প দিয়ে সুফল মেলেনি। এজন্য ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট লাগবে।- নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া
আশার কথা শোনাতে পারছেন না এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (সিডিএ)। সিডিএ বলছে, প্রকল্পের কাজ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরের আপত্তি, রেলওয়ের আপত্তি, জমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা, ট্রাফিক বিভাগের অনুমতি না পাওয়া, লালখান বাজার অংশের নকশা নিয়ে আপত্তি, কোভিডের সময় কাজে ধীরগতি, বিকল্প সড়ক চালু করতে সময়ক্ষেপণ এবং বন্দর সংলগ্ন এলাকায় নকশা পরিবর্তনসহ নানান কারণে দেরি হয়। প্রাক-সমীক্ষা অনুযায়ী উড়াল সেতুটি ব্যবহার উপযোগী করতে প্রকল্পের ১০টি র্যাম্প বাদে আরও র্যাম্প প্রয়োজন হবে। এতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে প্রকল্পের নতুন ব্যয়।
আরও পড়ুন
চট্টগ্রামে বিমানবন্দর সড়কে বড় বড় গর্ত, মেরামত নিয়ে রশি টানাটানি
ভারী যান চলাচলে বেহাল মাঝিরঘাট সড়ক, ধুলা-কাদায় অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা
সরকারি জমি দখলে নিলো এক ব্যাংক, আরেক ব্যাংক তুলছে নিলামে
প্রকল্প পরিচালকের অফিস সূত্রে জানা যায়, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ১০টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে নগরের পতেঙ্গামুখী অংশের আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামার র্যাম্প এবং আগ্রাবাদে ডেবার পাড়ে পতেঙ্গামুখী ওঠার র্যাম্প দুটির কাজ এখনো শুরুই হয়নি।
চারটির কাজ শেষ হয়েছে। পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজারমুখী অংশে নিমতলা মোড়ে নামা-ওঠার দুটি র্যাম্প, টাইগারপাসে আমবাগানমুখী নামার একটি র্যাম্প এবং লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গামুখী অংশে ফকিরহাটে নামার একটি র্যাম্পের কাজ শেষ। তবে এগুলো দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়নি।
বাকি চারটির কাজ চলমান। এর মধ্যে নগরের চট্টগ্রাম ইপিজেডের সামনে দুই অংশে ওঠা-নামার দুটি, কর্ণফুলী ইপিজেডের সামনে ওঠার একটি এবং জিইসি মোড়ে পতেঙ্গামুখী একটি ওঠার র্যাম্পের নির্মাণকাজ।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার জন্য নয়, পুরো নগরীর যানজট কমানোর জন্য করা হয়েছে। নকশা অনুযায়ী র্যাম্পগুলো না থাকলে মানুষ সুফল পাবে না। প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল করবে না।- চুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম
জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৭ সালের আগস্টে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। ওই সময় এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা। মেয়াদ ছিল তিন বছর। পরে দুবার বাড়িয়ে বর্তমানে চার হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ছুঁয়েছে প্রকল্পব্যয়। তিন দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্সপ্রেসওয়েটির উদ্বোধন করেন।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে কম খরচ দেখিয়ে প্রকল্প অনুমোদন নেওয়ার কৌশল হিসেবে একটি ফরমায়েশি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ তো এসব বোঝে না। এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে কিছু মানুষ হয়তো উপকার পাচ্ছে। কিন্তু তাদের ফিজিবিলিটিতে যে পরিমাণ ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল তা তো হচ্ছে না। কোটি টাকা খরচ করে ৮০ পৃষ্ঠার একটি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি রিপোর্ট বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটি অভিজ্ঞ কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এটি করালে ইফিশিয়েন্ট হতো।’
এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী করতে হলে আরও টাকা ব্যয় করতে হবে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি সুফল আসবে না। শুধু র্যাম্প দিলেই ব্যবহার বাড়বে, তা কিন্তু নয়। ঢাকায়ও র্যাম্প দিয়ে সুফল মেলেনি। এজন্য ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট লাগবে।’
প্রকল্পে অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘পুরো প্রকল্পে অনেক টাকা অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে। কিন্তু অত টাকার প্রয়োজন হতো না। কারণ সঠিক সমীক্ষা না থাকায় ভুলের ওপর কাজ করা হয়েছে।’
বর্তমানে প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তাতে পুরো কাজ শেষ হবে না। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমরা ৯টি র্যাম্প তৈরি করে এ প্রকল্পটি শেষ করবো।- সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম
তিনি বলেন, ‘জনগণের টাকায় এসব প্রজেক্ট হচ্ছে। এখন জনগণেরই প্রশ্ন তোলা উচিত- সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এ প্রকল্প কেন হলো? এই টাকা খরচ করে চট্টগ্রামের সমস্ত রোড নেটওয়ার্ককে পরিকল্পিতভাবে তৈরি করে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করা গেলে নগরবাসী অনেক বেশি সুবিধা পেতো, জনগণ আরও উপকারভোগী হতো। পরিবেশ রক্ষা হতো।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ২০২৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৬ হাজার ৩২৩টি গাড়ি চলাচল করবে। সবচেয়ে বেশি ৩৯ হাজার কার ও তিন চাকার অটোরিকশা চলার কথা। বর্তমানে দিনে গড়ে গাড়ি চলাচল করছে সাত হাজারেরও কম। সবগুলো র্যাম্প চালু হলে বোঝা যাবে প্রকৃত সংখ্যা।
সরেজমিনে দেখা যায়, লালখান বাজারে নামার র্যাম্পটির মধ্যখানে প্লাস্টিকের ডিভাইডার। একপাশের সরু পথে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি উঠছে। পুরো এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কিছু সিএনজি অটোরিকশা ও কয়েকটি প্রাইভেট কার-জিপ চলাচল করলেও কোনো বাস চলাচল করছে না। এক্সপ্রেসওয়ের দু-পাশের পুরো লেন প্রায় ফাঁকা।
চুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার জন্য নয়, পুরো নগরীর যানজট কমানোর জন্য করা হয়েছে। নকশা অনুযায়ী র্যাম্পগুলো না থাকলে মানুষ সুফল পাবে না। প্রত্যাশা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল করবে না।’
এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয় তখন সিডিএ চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুচ ছালাম। তিনিই প্রকল্পটি করার ক্ষেত্রে বেশি উদ্যোগী ছিলেন। পরে নগর আওয়ামী লীগের ওই সময়কার সহ-সভাপতি এম জহিরুল আলম দোভাষ দুই দফায় পাঁচ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে মাত্র সাড়ে চার মাস চেয়ারম্যান ছিলেন আরেক আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইউনুছ। ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম।
মো. নুরুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারটি করা হয়েছে বিমানবন্দরে সহজে যাতায়াতের জন্য। এটির সুফল ইতোমধ্যে নগরবাসী পেতে শুরু করেছে। কয়েকটি র্যাম্প স্থগিত রাখা হয়েছে। তাছাড়া মামলা জটিলতা, জায়গা অধিগ্রহণে প্রতিবন্ধকতার কারণে কয়েকটি র্যাম্পের কাজ ঝুলে ছিল। আবার টাইগারপাস ও আগ্রাবাদ র্যাম্প নিয়ে পাবলিক প্রতিবাদও ছিল। বাকি র্যাম্পগুলোর কাজ পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে শেষ হবে।’
চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমানে প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তাতে পুরো কাজ শেষ হবে না। বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আমরা ৯টি র্যাম্প তৈরি করে এ প্রকল্পটি শেষ করবো। বাকি যে র্যাম্প থাকবে সেগুলোর সঙ্গে আমরা কনসালট্যান্ট দিয়ে আর কোথায় কোথায় র্যাম্পের প্রয়োজন হবে, সেটা চিহ্নিত করে সিডিএর নিজস্ব অর্থায়নে সেকেন্ড ফেজে করার পদক্ষেপ নেবো।’
তবে সেকেন্ড ফেজের সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেকেন্ড ফেজ কখন হবে সেটা আপাতত বলা যাচ্ছে না। তবে ৯টি র্যাম্প চালু হলে পাবলিক অনেক সুবিধা পাবে।’
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম
What's Your Reaction?