আধুনিক বিপ্লবের প্রধান তাত্ত্বিক ভ্লাদিমির লেনিনের মতে, পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে আছে পুঁজিবাদী শ্রেণি ও সরকারি আমলাদের ষড়যন্ত্রে। নিজেদের স্বার্থ জিইয়ে রাখতে এরা রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে। আর এর ফলে নানাবিধ উপায়ে শোষণের শিকার হয় সাধারণ নাগরিক। সরকার ও সাধারণের মধ্যে বৈষম্যের দেওয়াল তৈরি হয়। এতে সুবিধা ভোগ করে বিশেষ শ্রেণি।
ক্ষমতাসীন মহল যখন পুরোনো কায়দায় দেশ শাসনে ব্যর্থ হয় এবং দেশের মানুষ সাবেকি কায়দা মেনে নিতে অস্বীকার করে; তখনই সৃষ্টি হয় বৈপ্লবিক পরিস্থিতি। প্রতিটি নাগরিক বিদ্রোহ, প্রতিটি গণ-আন্দোলন, প্রতিটি বিপ্লবের প্রধান কারণ বৈষম্য।
অতিসম্প্রতি গণ আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার বিদ্রোহের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে একদিনের আন্দোলন বা সংগ্রামে এ পরিবর্তন আসেনি।
কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে নিরীহ ছাত্র-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল এ অভ্যুত্থান। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে খড়গহস্ত হয়েছিল সরকার। দমন-পীড়ন আর প্রাণহানীর মধ্য দিয়ে এসেছে এ পরিবর্তন। শহর থেকে গ্রাম, সারাদেশে লেগেছিল রাজনীতির উত্তাল হাওয়া। সবই আমাদের জানা।
তবুও মানুষ তো বিস্মৃতিপরায়ণ, তাই ইতিহাস লিখে রাখতে হয়। নইলে নদীর মতো পলি জমে ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। অতিরঞ্জন বা বিরোধীদের হস্তক্ষেপেও বিকৃত হতে পারে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সেই সময়কে মলাটবন্দি করেছেন লেখক ও সাংবাদিক মেসবাহ য়াযাদ।
পেশাগত কারণে এ আন্দোলনকে তিনি পাখির চোখে দেখেছেন। সশরীরে উপস্থিত ছিলেন রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এলাকাগুলোতে। প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে গিয়ে ঝুলিতে পুরেছেন সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভের কারণ। আর সেসবই লিখে রেখেছেন তিনি তার ‘চব্বিশের বাংলাদেশ’ গ্রন্থে।
কোটা আন্দোলনের প্রথমের দিনগুলো থেকে শুরু হয়েছে এ দিনলিপি। ১৪ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন রোজকার রোজনামচা। প্রসঙ্গত উঠে এসেছে বৃটিশ শাসনামল, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের ঘটনাপ্রবাহ। শুধু আন্দোলন আর সরকার পরিবর্তনই নয়। অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়কার অরাজকতাও উঠে এসেছে এ বইয়ে। লিপিবদ্ধ আছে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের গ্রেপ্তারজনিত তথ্যও।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সম্প্রতি যে বৃহৎ ইতিহাসের স্বাক্ষী আমরা; সেই ইতিহাস কিনে পড়ার কী আছে? খুবই নিরীহ প্রশ্ন! উত্তরের প্রয়োজনে ফিরে যাই উপরে বলা কথাতেই, মানুষ বড়ই বিস্মৃতিপরায়ণ। পাঁচ, দশ বা পনেরো বছর পর আজকের ইতিহাস আর এমন নির্ভেজাল থাকবে না। সে সময়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক তথ্য জানাতে বইটি সংগ্রহে রাখা উচিত। সেই সাথে আন্দোলন চলাকালে নেটওয়ার্ক পরিষেবা বন্ধ থাকায় সব তথ্য সাধারণের জানার কথা নয়। রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দূরের জেলা বা মফস্বল শহরের মানুষের পক্ষে তাই সঠিক সংবাদ জানা সম্ভবও হয়নি। প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছিল তখন ঢাকায়, জানতে হলে পড়া দরকার ‘চব্বিশের বাংলাদেশ’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়, বিশেষ করে ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে কেন্দ্র করে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মলেনের পর—সবাই আ.লীগ, ছাত্রলীগ, জামায়াত, বিএনপি, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার, কোটা, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কারফিউয়ের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে।
এ সময়ের গল্পের পেছনের গল্প, মানুষের গল্প, অমানুষের গল্প, ক্ষমতার গল্প, অক্ষমতার গল্প, সাধারণের গল্প, অসাধারণের গল্প—একজন মাঠের সংবাদকর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতার গল্পকে, সময়ের একটি প্রামাণ্য দলিল মলাটবন্দি করার প্রয়াসই এ গ্রন্থ। এটি সময়ের একটি প্রামাণ্য দলিল।
‘চব্বিশের বাংলাদেশ’ প্রকাশ করেছে সাহিত্যদেশ। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী বিপুল শাহ। বইটি পাওয়া যাচ্ছে পিবিএস বুকশপ, পলল প্রকাশনী, বিশ্বরঙ, রকমারি, বইবাজার, বইফেরী, প্রথমা ও বাতিঘরসহ বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে।
এসইউ/জেআইএম