সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে যেন আলাদীনের চেরাগ খুঁজে পেলেন হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আনিসুর রহমান, স্টোর কিপার সুলেমান ও হিসাবরক্ষক ছমিরুল ইসলাম। তারা গত অর্থ বছরে হাসপাতালের জিনিসপত্র ও ওষুধ কেনার নামে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি প্রায় কয়েক কোটি টাকার অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। হাসপাতালের নতুন উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব অর্থ আত্মসাতের তথ্য সামনে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ মে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তারপরেই পুরোনো কায়দায় অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে হাসপাতালের স্টোর কিপার সুলেমান ও হিসাবরক্ষক ছমিরুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়কের রুমে গিয়ে তার স্বাক্ষর নিতে চাইলে এইসব অসঙ্গতিপূর্ণ বিল ভাউচার দেখে তিনি স্বাক্ষর দিতে রাজি হননি। পরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের নতুন উপ-পরিচালক (তত্ত্বাবধায়ক) ডা. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানকে জামায়াত-শিবিরের লোক আখ্যা দিয়ে অন্যত্র বদলি করার জন্য তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামান্ত লাল সেন বরাবর ডিও দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন।
এ ছাড়াও অপরিচিত ফোন নম্বর থেকে নানাভাবে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
অটোমেশন যন্ত্র ক্রয় করা হয় ২০১৮ সালে। এই মেশিনের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় দেখিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চার কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিল তোলা হয়। সদর হাসপাতালের ১৯টি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ, অনুষ্ঠান, উৎসব, সভা-সেমিনারের ব্যয় ২৪ লাখ, আপ্যায়ন ২১ লাখ, পাপোস কেনায় ১৪ লাখ, সিল ও স্ট্যাম্প প্যাড কেনায় ১১ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে কেবল ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরেই আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ওই অর্থ বছরের অডিট প্রতিবেদন তাই বলছে।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি এখন কথা বলতে চাই না।’ এ কথা বলেই ফোন কেটে দেন তিনি।
আরও পড়ুন
- ১৫ বছরে হানিফ-আতার ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে রকেটের গতিতে
- আবদুল হামিদের ছত্রছায়ায় অঢেল সম্পদের মালিক দুই ভাই
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষ যাতে ভয়ে কথা না বলতে পারে সেই জন্য সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনিসুর রহমান, হাসপাতালে স্টোর কিপার সুলেমান ও হিসাবরক্ষক ছমিরুল ইসলাম একটি চক্র তৈরি করেন। যে চক্র গত ২২-২৩ অর্থ বছরে হাসপাতালের নামে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে হরিলুট করা হয়েছে সেগুলো হল: অটোমেশন যন্ত্র ক্রয় করা হয় ২০১৮ সালে। এই মেশিনের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় দেখিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চার কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিল তোলা হয়।
হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আনিসুর রহমান ও স্টোর কিপার সুলেমান
সদর হাসপাতালের ১৯টি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ, অনুষ্ঠান, উৎসব, সভা-সেমিনারের ব্যয় ২৪ লাখ, আপ্যায়ন ২১ লাখ, পাপোস কেনায় ১৪ লাখ, সিল ও স্ট্যাম্প প্যাড কেনায় ১১ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে।
আমার সাথে উনার দেখাই হয় নাই। আমি উনাকে কিছুই বলিনি। উনি যদি থানায় অভিযোগ দিয়ে থাকেন তা হলে এগুলো মিথ্যা। উনার সাথে আমাদের কোনো হিসাব নেই। আমরা কোনো কাগজপত্র নিয়ে যাইনি উনার কাছে। উল্টো উনি ডায়ালাইসিসের মালামাল ক্রয় করে ঠিকাদারের টাকা আটকে রেখে দিয়েছেন।-স্টোর কিপার সুলেমান মিয়া
জেলা সদর হাসপাতালে কেবল ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরেই আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ওই অর্থ বছরের অডিট প্রতিবেদন তাই বলছে। কিন্তু হাসপাতালে কেনাকাটাসহ ৩২টি খাতে অর্থ ব্যয়ে ১৮ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দিয়েছেন হাসপাতালের নতুন তত্ত্বাবধায়ক। সেইসঙ্গে এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত হাসপাতালের স্টোর কিপার সুলেমান আহমদ, হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলাম ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক মো. আনিসুর রহমান (বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক) সেই সাথে তাদের পেছন থেকে ছায়া হিসেবে সহযোগিতা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন।
আরও পড়ুন
- লুটপাটের কারণে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
- বাংলাদেশ নয়, ভারতের বন্ধুত্ব হাসিনার সঙ্গে: রিজভী
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, এই প্রতিষ্ঠান মূলত স্টোর কিপার সুলেমান আহমদ ও হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলামের। তারা আড়ালে থেকে এই প্রতিষ্ঠানের নামে বিল নিতেন। শহরের মেসার্স জননী ক্লথ স্টোর, মেসার্স রায় ট্রেডার্স ও মেসার্স অনিক ট্রেডার্স নামের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ক্রয়ের নামে প্রায় ২০ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পাপোসই আছে ১২ লাখ টাকার।
আওয়ামী লীগ বরাবর অভিযোগ
অভিযুক্ত হাসপাতালের স্টোর কিপার সুলেমান মিয়া বলেন, আমার সাথে উনার দেখাই হয় নাই। আমি উনাকে কিছুই বলিনি। উনি যদি থানায় অভিযোগ দিয়ে থাকেন তা হলে এগুলো মিথ্যা। উনার সাথে আমাদের কোনো হিসাব নেই। আমরা কোনো কাগজপত্র নিয়ে যাইনি উনার কাছে। উল্টো উনি ডায়ালাইসিসের মালামাল ক্রয় করে ঠিকাদারের টাকা আটকে রেখে দিয়েছেন।
অটোমেশন যন্ত্র ক্রয় করা হয় ২০১৮ সালে। এই মেশিনের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় দেখিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চার কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিল তোলা হয়। সদর হাসপাতালের ১৯টি কম্পিউটারের ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি ক্রয় ও মেরামত দেখিয়ে প্রায় ২৪ লাখ, অনুষ্ঠান, উৎসব, সভা-সেমিনারের ব্যয় ২৪ লাখ, আপ্যায়ন ২১ লাখ, পাপোস কেনায় ১৪ লাখ, সিল ও স্ট্যাম্প প্যাড কেনায় ১১ লাখ টাকার বিল তোলা হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতালে কেবল ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরেই আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ওই অর্থ বছরের অডিট প্রতিবেদন তাই বলছে।
সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমানে সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, মূলত আমি সুনামগঞ্জের হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের ছিলাম। আমি থাকাকালীন অনেক কাজ হয়েছে হাসপাতালের। তবে নতুন তত্ত্বাবধায়ক আমার হিসাবে অডিট আপত্তি জানিয়েছেন। আমি তার লিখিত জবাব দিব। তবে যে সকল অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে উঠেছে এগুলো আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি গ্রুপ ইচ্ছে করে করছে।
আরও পড়ুন
- দুই মায়ের নামে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় খুলে লোক ঠকাতেন নুরুজ্জামান
- ডুপ্লেক্স বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ, ‘দেশ ছেড়েছেন’ শামীম ওসমান
সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) মোহাম্মদ. মাহবুবুর রহমান বলেন, সুলেমান ও ছমিরুলই সুনামগঞ্জের এক আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম করেছেন। মূলত এরাই সব অনিয়ম-দুনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমাকেও তারা নানাভাবে হয়রানি ও হুমকি দিচ্ছে। আমি প্রশাসন ও পুলিশকে সব অবহিত করেছি। নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছি।
জিডির কপি
এদিকে, সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের এ অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর মাধ্যমে স্মারকলিপি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যরা।
এলএএইচ/এসএইচএস/এমএস