চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি শহর চংকিং ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার নতুন বাণিজ্য সেতুতে। অনেকের কাছে এটি এখন ‘সুয়েজ খালের’ বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রেলভিত্তিক এই করিডরকে অনেকে বলছেন স্থলভিত্তিক ‘সুয়েজ খাল’।
চংকিংয়ের ভৌগোলিক অবস্থান ও শিল্পভিত্তিক সক্ষমতা একে করে তুলেছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন এখান থেকে শত শত মালবাহী ট্রেন রওনা হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ যেমন ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি থেকে ইউরোপের দেশগুলো- বিশেষত জার্মানি ও পোল্যান্ডে। এই স্থলপথ ব্যবহার করে পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগছে সমুদ্রপথের তুলনায় ১০ থেকে ২০ দিন কম। ফলে কাস্টমস জটিলতা, পরিবহন ব্যয় ও ঝুঁকিও অনেকটা কমে আসছে।
২০২৩ সালে চালু হওয়া আসিয়ান বুলেট ট্রেন হ্যানয় থেকে চংকিংয়ের যাত্রাপথকে আরও দ্রুত করেছে। এখন মাত্র পাঁচ দিনে পণ্য চংকিংয়ে পৌঁছায়, সেখান থেকে ইউরোপে পৌঁছাতে লাগে দুই সপ্তাহেরও কম সময়। ব্যবসায়ীদের কাছে এটি দ্রুত ডেলিভারির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
শুধু পরিবহনই নয়, চংকিং নিজেই একটি বিশাল শিল্পকেন্দ্র। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ল্যাপটপ এখানেই তৈরি হয়। বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদনে শহরটির অবদান উল্লেখযোগ্য। আবার চীনের মোট গাড়ি রপ্তানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে এখানকার কারখানা থেকে। এই শিল্প শক্তি চংকিংকে কেবল একটি লজিস্টিক হাব নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেছে।
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
তবে চীনের এই উদ্যোগের পেছনে শুধু বাণিজ্যিক নয়, ভূরাজনৈতিক দিকও রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে শুরু হওয়া মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ ও করোনা মহামারি চীনকে দেখিয়েছে, সুয়েজ খাল, মালাক্কা বা হরমুজ প্রণালির মতো পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সমুদ্রপথের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আবার ইউক্রেন যুদ্ধ ও ২০২৩ সালে কিছু চীনা চালান জব্দ হওয়ার ঘটনায় রাশিয়া হয়ে পণ্য পাঠানোও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। যদিও দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২৪ সালে ২৪ হাজার কোটি ইউরোতে পৌঁছেছে, তবুও রাশিয়ার ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে চাইছে না বেইজিং। এজন্যই তারা এখন কাজাখস্তান ও কাস্পিয়ান সাগর হয়ে ‘মিডল করিডর’ উন্নয়নের পরিকল্পনা করছে।
তবে নতুন এই বাণিজ্যপথের অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে। কাস্টমস বিলম্ব, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং আর্থিক টেকসইতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে যেসব রুট তৈরি হয়েছে, তার বেশির ভাগই এখনো সরকারি ভর্তুকি ছাড়া চালানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে এই করিডরের সাফল্য নিশ্চিত করতে হলে খরচ কমানো ও অবকাঠামোগত ঘাটতি মেটানো জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবুও বিশ্লেষকদের মতে, চংকিংয়ের এই উদ্যোগ বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন ধারা আনতে পারে। একদিকে সমুদ্রপথের ওপর চাপ কমবে, অন্যদিকে সময় ও ব্যয় সাশ্রয় হবে। তবে এটি কতটা স্থায়ী সমাধান হতে পারে, তা নির্ভর করবে চীন কীভাবে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করতে পারে তার ওপর।
সূত্র: ইয়াহু নিউজ
এসএএইচ