- • এক বছরে সোনার বাজার কমেছে ২০ শতাংশ
- • পাঁচ বছরে দাম বেড়ে দ্বিগুণ
- • প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকার সোনা চোরাচালান
- • বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশ
- • ব্যবসায়ীরা বিপাকে, জুয়াড়িদের নিয়ন্ত্রণে সোনা
এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে গুনতে হচ্ছে দুই লাখ টাকার বেশি (ভ্যাট-মজুরিসহ)। চড়া দামে ক্রমে ছোট হচ্ছে সোনার বাজার। স্বর্ণালংকার এখন অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ক্রেতাদের আনাগোনা কম। ক্রেতা সংকট দেখা দেওয়ায় দেশে সোনার বাজারের আকারও ছোট হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে সোনার অলংকার ব্যবসায় মন্দা চলছে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকেই। গত পাঁচ বছরে দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। বিপরীতে সোনার দাম বেড়েছে হু হু করে। ফলে বিক্রি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে সোনার অলংকার বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশের মতো। উৎসব-পার্বণে মানুষ এখন আগের মতো সোনার অলংকার কিনছে না। শখের বশে সোনার অলংকার কেনাও অনেকটা বন্ধ। একেবারে বাধ্য না হলে কেউ জুয়েলারিমুখী হচ্ছে না। বিক্রি না থাকায় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ছোট করছেন ব্যবসার আকার।
সোনার দামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো বিশ্বে অল্প কয়েকজন সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের বেশিরভাগ ইসরায়েলি ব্যবসায়ী। বাংলাদেশি তো দূরের কথা, এশিয়ার কোনো ব্যবসায়ীও এ তালিকায় নেই।- বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া
তারা বলছেন, সোনার ব্যবসা এখন আর সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই, জুয়াড়িদের দখলে চলে গেছে। একদল সোনার বাজারকে এখন জুয়ার দানের মতো ব্যবহার করছেন। ফলে সোনার দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দেশে সোনার বাজারের প্রকৃত আকার কত, সে বিষয়ে কোনো গবেষণা বা জরিপ কেউ করেনি। তবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) এক প্রতিবেদনে দেশের সোনার বাজারের আকার দুই লাখ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়। বর্তমান বাজার এর চেয়ে ২০ শতাংশের মতো কমেছে বলে জানান বাজুসের দায়িত্বশীলরা। সে হিসাবে বর্তমানে দেশে সোনার বাজারের আকার এখন দেড় লাখ কোটি টাকার মতো।
অনেকেই ঠিকমতো কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না। তবে ব্যবসা মন্দা গেলেও আমাদের কোনো সদস্য ব্যবসা বন্ধ করেননি। কিন্তু অনেকেই ব্যবসার পরিসর ছোট করে ফেলেছেন। সামনে ব্যবসার পরিসর আরও ছোট হতে পারে।- বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন
বিশ্ববাজারেও সোনার দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। হু হু করে বেড়ে মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) প্রতি আউন্স সোনার দাম রেকর্ড তিন হাজার ৬৯১ ডলারে ওঠে। অতীতে বিশ্ববাজারে সোনার এত দাম কখনো দেখা যায়নি। এমনকি চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) আগে এক আউন্স সোনার দাম কখনো তিন হাজার ৬শ ডলার হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রথমবার এক আউন্স সোনার দাম তিন হাজার ৬শ ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়ে বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে দেশের বাজারেও সোনার রেকর্ড দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম এক লাখ ৮৯ হাজার ৬২২ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনা এক লাখ ৮২ হাজার ২ টাকা, ১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনা ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৩ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সোনার এই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও ন্যূনতম ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করে সোনার অলংকার বিক্রির নিয়ম করা হয়েছে। এতে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনায় ভ্যাট নির্ধারিত হয়েছে ৯ হাজার ৪৮১ টাকা। আর মজুরি ১১ হাজার ৩৭৭ টাকা। ফলে ভালো মানের এক ভরি সোনার গহনা কিনতে ক্রেতাদের ২ লাখ ১০ হাজার ৪৮০ টাকা গুনতে হবে।
সোনার দামের যত রেকর্ড
বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম ছিল ৬ হাজার ৯শ টাকা। এরপর কয়েক দফা বেড়ে ২০১০ সালে ৪২ হাজার ১৬৫ টাকায় ওঠে। দেশে এক ভরি সোনার দাম প্রথম ৫০ হাজার টাকা হয় ২০১৮ সালে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এক ভরি সোনার দাম ৬০ হাজার ৩৬১ টাকায় ওঠে। দেশের বাজারে এক ভরি সোনার দাম প্রথম এক লাখ টাকা হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এক ভরি সোনার দাম প্রথমবার ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মাইলফলক স্পর্শ করে।
- আরও পড়ুন
- সব রেকর্ড ভেঙে নতুন উচ্চতায় সোনার দাম
- বিশ্ব বাজারে সোনার দাম দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ
- ২১ নাকি ২২ ক্যারেট সোনা ভালো, আসল নকল চিনবেন যেভাবে
এদিকে গত বছরের শুরুতে ভালো মানের এক ভরি সোনার দাম ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকা। বছর শেষে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। এ হিসাবে ২০২৪ সালে সোনার দাম বাড়ে ২৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের সাড়ে নয় মাসে দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে সোনার দাম বেড়েছে ২১৪ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে সোনার দাম বেড়ে তিনগুণ হয়েছে।
প্রতিদিন আসে ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনা
বাজুসের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে প্রতিদিন সারাদেশের পানি, স্থল ও আকাশপথে প্রায় ২০০ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে, যা ৩৬৫ দিন বা এক বছর শেষে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
বাজুসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সোনার বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়েছে চোরাকারবারিদের দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে। পোদ্দারদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সোনার পাইকারি বাজার। পোদ্দারদের সঙ্গে চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে স্থানীয় পোদ্দার বা বুলিয়ন বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হচ্ছে।
জুয়াড়িদের দখলে সোনার বাজার
সোনার অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোনার দামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো বিশ্বে অল্প কয়েকজন সোনার বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের বেশিরভাগ ইসরায়েলি ব্যবসায়ী। বাংলাদেশি তো দূরের কথা, এশিয়ার কোনো ব্যবসায়ীও এ তালিকায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘সোনার বাজার এখন জুয়াড়িদের দখলে চলে গেছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন কোণঠাসা। বিশ্ববাজারে এক আউন্স সোনার দাম তিন হাজার ৬শ ডলার হবে, এটা আগে আমরা কল্পনাও করিনি। অথচ এখন এক আউন্স সোনার দাম তিন হাজার ৭শ ডলারের কাছাকাছি। বিশ্ববাজারে এমন দাম বাড়ার কারণে আমাদের দেশেও সোনার দাম বাড়ছে।’
বাজুসের এই সাবেক সভাপতি বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণে সোনার অলংকার বিক্রি এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। ৮০ শতাংশের বেশি বিক্রি নেই হয়ে গেছে। বিক্রি না থাকায় ব্যবসায়ীরা বিপাকে রয়েছেন। অনেকেই প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, কর্মীদের বেতন পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে কয়েক বছর আগেও নতুন শিশুর জন্ম, বিয়ে, জন্মদিন, মুসলমানি, শিশুর মুখে ভাতে নিকটাত্মীয়দের সোনার অলংকার উপহার দেওয়া অনেকটাই রীতি ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি আর নেই। কেউ একেবারে বাধ্য না হলে সোনার অলংকার কিনছেন না। কারণ এখন দুই আনার একটি অলংকার কিনতে গেলেও প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাগে। আর দুই আনার একটি অলংকার খুবই ছোট। এর থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা নগদ দিলে মানুষ বেশি খুশি হয়।
বাংলাদেশে সোনার বাজারের আকার কত এবং বৈধভাবে দেশে কি পরিমাণ সোনা আসে? এমন প্রশ্ন করা হলে ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন, ‘সোনার বাজার কত এটা নিয়ে আমার জানামতে কোনো জরিপ হয়নি। তাই আন্দাজে এটা বলা ঠিক হবে না। আর আমাদের দেশে সোনা বৈধভাবেই আসে। সরকার নির্ধারিত ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়েই সোনা আনা হয়।’
যে কারণে বাড়ছে সোনার দাম
বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্যাক্সেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সোনার দাম বাড়ার কারণে জুয়েলারি ব্যবসায় মন্দা চলছে। দেশের সোনার বাজারের আকারও ছোট হচ্ছে। আমাদের হিসাবে ২০২৪ সালে দেশে সোনার বাজারের আকার ছিল দুই লাখ কোটি টাকা। এখন তার থেকে ২০ শতাংশের মতো কমে গেছে।’
সোনার বাজার নিয়ে আপনারা কি বিশেষভাবে কোনো জরিপ করেছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ওইভাবে জরিপ করা সম্ভব নয়। সরকারের কেউ জরিপ করেনি। আমরা জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে এবং কাস্টমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মিলিয়ে একটা জরিপ করি।’
এখন সোনার দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার শুল্ক নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ভারত একসঙ্গে বৈঠক করছে। তার একটি প্রভাব পড়ছে ডলারে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি ঝামেলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের লোকরাও ডলারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে, মানে নিরাপদবোধ করছে না। এ কারণে এখন চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ সোনা কিনে রিজার্ভ করছে। আরেকটা হলো সরবরাহ কম। খনি থেকে ওইভাবে সোনা তোলা হচ্ছে না। এসব কারণে সোনার দাম বাড়ছে।’
দাম বাড়ার ফলে ব্যবসায় কোন ধরনের প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সোনার অলংকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক আগেই এটা গেছে। শখ করে এখন আর কেউ সোনার অলংকার কেনে না। হয়তো ছেলে-মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা কিনছে। সোনার অলংকার বিক্রি কমে গেছে ৮০ শতাংশের মতো।’
আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘বিক্রি না থাকায় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ঠিকমতো কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না। তবে ব্যবসা মন্দা গেলেও আমাদের কোনো সদস্য ব্যবসা বন্ধ করেননি। কিন্তু অনেকেই ব্যবসার পরিসর ছোট করে ফেলেছেন। সামনে ব্যবসার পরিসর আরও ছোট হতে পারে।’
এমএএস/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস