ছাত্র ইউনিয়ন নেতার ‘লাল সন্ত্রাস’র ডাক, ঢাবিতে উত্তেজনা
‘লাল সন্ত্রাসই একমাত্র পথ বা উপায়’ বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মেঘমল্লার বসু। একই সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছেন সশস্ত্র যুদ্ধের। তিনি মনে করেন, জনগণের সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক সহিংসতা সংঘটিত করতে হবে।
লাল সন্ত্রাস ও সহিংসতার এই হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচি থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাবিতে থাকা কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের গ্রাফিতিতে জুতা নিক্ষেপ করে তা মুছে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
গতকাল শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে সমাবেশে মিলিত হন। সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এলাকায় সিরাজ সিকদারের গ্রাফিতিতে জুতা নিক্ষেপ করেন এবং গ্রাফিতি মুছে ফেলেন।
এসময় শিক্ষার্থীরা- ‘লাল সন্ত্রাসের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’; ‘একশন টু একশন, ডাইরেক্ট একশান’; ‘লাল সন্ত্রাসের/শাহবাগীদের/ গাজাখোরদের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট একশান’; ‘লাল সন্ত্রাসের চামড়া, তুলে নেবো আমরা’; ‘লাল সন্ত্রাসের ঠিকানা, এ ক্যাম্পাসে হবে না’; ‘উদ্যানের গাজাখোর, উদ্যানে ফিরে যা’; ‘মেঘমল্লারের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’; ‘হৈ হৈ রৈ রৈ মেঘমল্লার গেলি কই’; ‘জঙ্গি বসুর ঠিকানা এ ক্যাম্পাসে হবে না’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ঢাবি শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ বলেন, এরা ৮০ ও ৯০ এর দশকের মতো আবারও সন্ত্রাসবাদ কায়েম করতে চায়, তারা ডাকসুকে এভাবেই ভন্ডুল করেছিল ৯০ এর দশকে। আজ ওই সন্ত্রাসীরা আবারও সন্ত্রাসবাদের ঘোষণা দিচ্ছে। এই সন্ত্রাসীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করতেই হবে।
আরেক শিক্ষার্থী এবি জুবায়ের বলেন, ঢাবি ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি দেখলাম সরাসরি লাল সন্ত্রাসের হুমকি দিয়েছেন। এই বক্তব্য জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়। বিক্ষোভ থেকে বলতে চাই এটি সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। তাদেরকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।
আজিজুল হক নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এই সংগঠন আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে কাজ করেছে। ছাত্রলীগ ছাত্রদল-শিবিকে দমন করেছে কিন্তু এদেরকে জায়গা দিয়েছে। নতুন এই বাংলাদেশে বলতে চাই নতুন করে কাউকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে দেওয়া হবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, আমরা যখন ক্যাম্পাসে এসেছি সন্ত্রাসীরা একমাত্র এইসকল বামদেরকে জায়গা করে দিয়েছে। জুলাইয়ের মতো একটি বিপ্লবের পর এখনো দেখছি তারা আওয়ামী ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করতে চায়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে উদ্দ্যানের গেট বন্ধের পর তারা মব করেছে। প্রক্টরের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে লাল সন্ত্রাসের হাত ছিল। এদেরকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লাল সন্ত্রাসী মেঘমল্লার বসুকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
এর আগে, শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে এক ইংরেজি বার্তায় মেঘমাল্লার বসু বলেন- একমাত্র পথ হলো লাল সন্ত্রাস। প্রান্তিক জনগণের সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক সহিংসতা। যতদিন আমরা শুধু প্রার্থনা সভা এবং মিছিল করে যাব, যা কখনো সহিংস হওয়ার ক্ষমতা রাখে না, ততদিন তুমি তোমার সাথীদের সুরক্ষিত করতে পারবে না। মানুষ তোমাকে পছন্দ করবে, কিন্তু কেউ অনুপ্রাণিত হবে না। আর কেউ আরেকটি ‘উদারপন্থি’ দলের প্রয়োজন অনুভব করে না। কেউ ইচ্ছাকৃত শহীদদের পরোয়া করে না। একমাত্র ভালো ফ্যাসিস্ট হলো মৃত ফ্যাসিস্ট।
তিনি বলেন, এই ডানপন্থি উন্মাদনার মধ্যে তোমাকে সার্বভৌমত্বের নামে হত্যা করা হবে এবং তারপর তোমার চরিত্র হনন করা হবে। মাতাল উদারপন্থি ও ‘কেন্দ্রপন্থিরা’, যারা ইতোমধ্যেই তাদের মন-প্রাণ ডানপন্থার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, তারা দাবি করবে এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং উভয়পক্ষই খারাপ। তোমার সাথি খুবই কম। তুমি একটিকেও হারানোর মতো অবস্থায় নেই। আর মানুষ ভেড়ার মতো। তুমি কি সারা জীবনের জন্য একজন রাখাল হওয়ার জন্য প্রস্তুত?
মেঘমল্লার আরও বলেন, পাবলিক ডেমোনস্ট্রেশন করা বন্ধ করো। কমিটির কার্যক্রম প্রকাশ্যে প্রচার করা বন্ধ করো। আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। দাঁত আর নখ বেরিয়ে আসছে। ট্রল আর মিম করে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। এবার এটি গোপনে নিয়ে যাও, কমরেড। অপেক্ষা করো। এর বেশি প্রকাশ্যে বলার প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে, মেঘমল্লার বসুর লাল সন্ত্রাসের আহ্বানের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি সাফিক কায়েম। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে দেশি-বিদেশি চক্রের বহু ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছি। চব্বিশের প্রজন্ম বেঁচে থাকতে আর এই দেশকে অস্থিতিশীল করতে দেওয়া হবে না। দেশের তরুণ ছাত্রসমাজ সজাগ রয়েছে। জাতীয় সংহতি, সম্প্রীতি, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরকারকে অবশ্যই সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে যারা লাল সন্ত্রাসের ডাক দিয়ে উসকানিমূলক পরিবেশ সৃষ্টি করছেন, তাদেরকে হুঁশিয়ার করে বলতে চাই- জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতি করুন। দেশের আপামর জনসাধারণ একবার বিক্ষুব্ধ হলে তার ফল সুখকর হবে না।
ঢাবি ছাত্র শিবিরের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, লাল সবুজ বা নীল সব রঙের টেররই আমরা দেখেছি। গত ১৬ বছর এবং সেই টেরররের এনাবলার ছিল এই বসুরা। আজ সেটা শুধু স্বীকার করছে। তাদের এই স্টেটমেন্ট শুধু ভবিষ্যতের জন্য না, অতীতের পাপের কনফেশন।
প্রসঙ্গত, উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, লাল সন্ত্রাস বা রেড টেরর হলো সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিকদের মাধ্যমে পরিচালিত রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং মৃত্যুদণ্ডের একটি প্রচারণা, যা প্রধানত চেকা নামক বলশেভিক গোপন পুলিশের মাধ্যমে করা হতো। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে শুরু হয়েছিল এবং ১৯২২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। ভ্লাদিমির লেনিনের হত্যা চেষ্টা এবং পেট্রোগ্রাদ চেকা নেতা মোইসেই ইউরিতস্কি ও পার্টি সম্পাদক ভি. ভলোদারস্কির সফল হত্যাকাণ্ডের পর, যা বলশেভিক গণপ্রতিহিংসার জন্য প্রতিশোধমূলক বলে অভিযোগ করা হয়। লাল সন্ত্রাস ফরাসি বিপ্লবের ত্রাসের শাসনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং এর লক্ষ্য ছিল বলশেভিক শক্তির বিপক্ষে রাজনৈতিক বিরোধিতা, প্রতিপক্ষ এবং অন্য যেকোনো ধরনের হুমকি নির্মূল করা।