অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ছোটবেলা থেকেই স্পষ্টবাদী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। যেখানে অন্যায় দেখতেন সেখানেই প্রতিবাদ করতেন। যা বলতেন তা আদায় করে ছাড়তেন। বলতে গেলে ছিলেন অনেকটাই একরোখা। তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবা মো. বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান।
স্কুলশিক্ষক বিল্লাল হোসেনের চার সন্তানের মধ্যে আসিফ দ্বিতীয় এবং একমাত্র ছেলে। তার বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর গ্রামে। বাবা বিল্লাল হোসেন আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা রোকসানা আক্তার একজন গৃহিণী।
আন্দোলন চলাকালীন সময়ের কথা বলতে গিয়ে বিল্লাল হোসেনের চোখে পানি চলে আসে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, “আমাদের ছেলে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রথমদিকে বিষয়টি জানতাম না। শুরুতেই যখন পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র মারা যায়, তখন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি, আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে আসিফও একজন। তখন ফোনে আসিফকে বাড়িতে ফিরে আসতে অনুরোধ করি আমরা। উত্তরে আসিফ বলে, আমার অনেক ভাইবোন শহীদ হয়েছেন, আন্দোলন থেকে ফিরে আসা যাবে না। হয় গুলি খেয়ে মরবো, না হয় আন্দোলন সফল করে ঘরে ফিরবো’।”
‘এরপর থেকেই আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। প্রতিদিন আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করি। হঠাৎ ১৯ জুলাই তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চিন্তা বাড়তে থাকলো। খবর আসে আসিফ নিখোঁজ হয়েছে। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে থাকি। পাঁচ দিনেও তার কোনো সন্ধান না পেয়ে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। পরিবারের নেমে আসে অমাবশ্যার রাত। ঘরে রান্না-বান্নাও বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলের লাশ ঘরে গিয়েও তাকে খুঁজেছি। ২৩ জুলাই পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় আসিফকে গুম করা হয়েছে। দ্রুত শাহবাগ থানায় দিয়ে নিখোঁজের ডায়েরি করতে গেলে ওসি আমাদের জিডি নেননি। হতাশ হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় যাই। কিন্ত সেখানেও একইভাবে আমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে সংবাদ সম্মেলন করে আসিফের গুমের বিষয়টি দেশবাসীকে জানানো হয়’, যোগ করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল হোসেন।
২৪ জুলাই হাতিরঝিল এলাকায় আসিফ মাহমুদকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় জানিয়ে বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এসময় তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিলে সেখান থেকে ২৬ জুলাই পুলিশ পরিচয়ে আবারও তুলে নিয়ে যায়। ২৭ জুলাই ডিবি কার্যালয় থেকে ফোন করে জানানো হয়, আপনার ছেলে ডিবি কার্যালয় আছে, এসে দেখে যান। আমি আর আসিফের মা সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেখানে ডিবিপ্রধান হারুন আমাকে দিয়ে একটি ভিডিও রেকর্ড নিতে চেয়েছিল যে, সমন্বয়করা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা স্বেচ্ছায় দিয়েছেন। তার এ প্রস্তাবে আমি রাজি হইনি। পরে আমরা বাড়িতে চলে আসি। একদিন পর ডিবি থেকে আবারও ফোন করা হলে দ্রুত সেখানে যায়। তখন তাদের গাড়ি দিয়ে আসিফসহ আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘অবশেষে স্বৈরাচার হাসিনার পতন হয়েছে। ছাত্রদের জয় হয়েছে। আসিফ মাহমুদের এমন সাফল্যে আমি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। তার সাফল্যে আমার গ্রামবাসীও আনন্দিত। আসিফের বাবা হতে পেরে আমি গর্বিত। আমি চাই আমার ছেলে মানুষের কল্যাণে কাজ করুক।’
স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সালাউদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসিফ ছোট থেকেই অনেক ভদ্র ও মেধাবী। তার পারিবারিকও সুনাম রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়ে তিনি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। এ আনন্দে বৃহস্পতিবার রাতে আকুবপুরে স্থানীয়রা মিষ্টি বিতরণ করেছেন। তার এ সাফল্যে গ্রামবাসী খুশি।’
আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অজোপাড়া গাঁয়ের ছেলে আসিফ মাহমুদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আজ সফল হয়েছেন। তিনি শুধু মুরাদনগর নয়, পুরো কুমিল্লার জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন। তার এমন সাফল্যে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। ভবিষ্যতে তার আরও সফলতা কামনা করছি।’
- আরও পড়ুন
- যেসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ড. ইউনূস
আসিফ মাহমুদ আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। পরে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ ভর্তি হন। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা।
এসআর/জিকেএস