নেত্রকোনার সবকটি হাওরে এখনো থই থই করছে পানি। কবে পানি নামবে আর কবে শুরু হবে বোরো আবাদ, এ নিয়ে শঙ্কিত হাওরপাড়ের কৃষকরা। বোরো আবাদের জন্য বীজতলাও তৈরি করতে পারছেন না চাষিরা। দেরিতে বোরোর আবাদ হলে হাওরের ফসলে আগাম বন্যার আশঙ্কা দেখা দেবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নেত্রকোনার ছোট বড় ১৩৪টি হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য হাইড্রোলিক ৪০২টি জলকপাট (স্লুইচগেট) রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কাজ করছে ৩২৭টি। অকেজো রয়েছে ৭৫টি জলকপাট। কিন্তু কাগজে কলমে ঠিক থাকলেও এসবের অধিকাংশই এখন অকেজো। ফলে হাওর থেকে পানি নামছে খুব ধীরে। এছাড়া আশ্বিনের আকস্মিক বন্যার কারণে পানিতে ভরপুর হাওর।
গবেষকরা বলছেন, হাওরে ভূপ্রকৃতি বিবেচনায় এর উন্নয়ন হয় না। অপরিকল্পিত বাঁধ ও এখানকার নদীগুলো নাব্যতা হারানোর কারণে হুমকিতে রয়েছে হাওরের পরিবেশ। ফলে একদিকে যেমন কমছে হাওড়ের মিঠা পানির মাছ, অন্যদিকে বারবার আগাম বন্যায় নষ্ট হয় বছরের একমাত্র ফসল।
হাওর এলাকায় প্রতিবছর মার্চ থেকে এপ্রিলের মধ্যে পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কা থাকে। এ সময় হাওরের ধান পাকতে শুরু করে। হাওর অঞ্চলের প্রায় ৪১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসলের ঝুঁকি এড়াতে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে থাকে। কিন্তু পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বছরের এমকমাত্র বোরো ফসল।
নেত্রকোনার কীর্তনখলা হাওর, ডিঙ্গাপোতা, চরহাইজদাসহ বড় ফসলি হাওরের জল কপাটগুলোও অকেজো হয়ে রয়েছে। বোরো মৌসুমে বীজতলা তৈরির কাজ শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহে। হাওরপারের উঁচু স্থানে (স্থানীয়ভাবে এ স্থানকে কান্দা বলে) বীজতলা করা হয়। কিন্তু এবার বীজতলার কাজ প্রায় ১৫ দিন পিছিয়েছে। তাই বোরো আবাদও পেছাবে ১৫ দিন। দেরিতে ধান লাগালে সেই ধান পাকবেও দেরিতে। তখন হয়তো দেখা যাবে, ধান পাকার আগেই উজান থেকে ঢলের পানি চলে এসেছে।
জেলার খালিয়াজুরী সদরের পুরানহাটি গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার ও মহসিন মিয়া বলেন, কীর্তনখোলা হাওরের কীর্তনখোলা বাঁধে ২টি জলকপাট রয়েছে। এরমধ্যে একটি নষ্ট আরেকটি কিছুটা ভালো রয়েছে। একদিকে ফসলরক্ষা বাঁধের চিন্তা আরেকদিকে জলকপাটের চিন্তা থাকে। ঋণ করে বছরের একমাত্র ফসল করলেও আগাম বন্যায় সব নিয়ে যায়।
একই উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কৃষক কুদ্দুছ মিয়া ও আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আশ্বিনের বন্যার কারণে হাওরের পানি নামছে না। আমরা বোরোর বীজতলা তৈরি করতে পারছি না। বীজতলা না জাগলে ফসলের চাষাবাদ পিছিয়ে যাবে। চাষাবাদ পেছালে বন্যায় ফসলহানির ঝুঁকিও বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্যমতে, হাওরে হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টন। হাওরাঞ্চলের মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষকদের প্রায় ৪১ হাজার হেক্টর জমি আছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিকটন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। হাওরের পানি নামতে দেরি হলে চাষাবাদ পিছিয়ে যায়। এতে আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকে ফসল।
এদিকে অধিকাংশ জলকপাটই সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়ে নেত্রকোনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান বলেন, ৩ বছর আগে এসব জলকপাট সংস্কার করতে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। যা বর্তমানে ৩৪ কোটি টাকার ওপরে লাগবে। বরাদ্দ পেলে জলকপাটগুলো সংস্কার করা হবে। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের জন্য এবছর ৯০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমরা বরাদ্দ পেয়েছি ১৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি আশ্বিনের বন্যায় বোরো আবাদের শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হবে। তবে পানি প্রাকৃতিকভাবেও কমে। বাষ্প হয়েও উড়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নূরুজ্জামান বলেন, বোরোর বীজতলা জেগেছে। বীজতলা সাধারণত উঁচু স্থানেই হয়। তবে হাওরের পানি নামতে কিছুটা দেরি হবে। আশা করছি সঠিক সময়ে বোরো চাষাবাদ হবে।
এইচ এম কামাল/এফএ/এএসএম