জাতিসংঘের দুই-রাষ্ট্র সমাধান উদ্যোগ: আশা ও আশঙ্কা

9 hours ago 6

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আজ বিশ্বের দীর্ঘতম রাজনৈতিক ট্র্যাজেডিগুলোর একটি। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এ সংকট শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে নয়, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, কূটনীতি ও মানবিকতার মানচিত্রকেও প্রভাবিত করে আসছে। জাতিসংঘ জন্মলগ্নেই দুই-রাষ্ট্র সমাধানের যে নকশা দিয়েছিল—একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র—তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। ইসরায়েল রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও টিকে থাকার কাঠামো পেয়ে গেলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজও কেবল প্রত্যাশার আকাশেই ভাসছে। এ অনুপস্থিতির ফাঁকেই দখলদারত্ব, যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট, নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ এবং মানবিক বিপর্যয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেশের সমর্থনে গৃহীত নতুন ঘোষণা আবারও আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রশ্নকে। ঘোষণায় শুধু ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘বাস্তব, সময়সীমা নির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়নি, বরং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাসের আক্রমণ যেমন নিন্দিত হয়েছে, তেমনি গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচারে হামলা, অবরোধ ও বেসামরিক জনগণকে অনাহারে রাখার নীতিকেও কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। এভাবে প্রস্তাবটি একইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রীয় দমননীতি—উভয়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।

এই প্রস্তাবে ১৪২টি দেশ সমর্থন জানালেও কয়েকটি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট প্রদানকারী ১০টি দেশ হলো: যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, মাইক্রোনেসিয়া, নাউরু, পলাউ, পাপুয়া নিউ গিনি, প্যারাগুয়ে ও টোঙ্গা।
আর ভোটদানে বিরত থাকা ১২টি দেশ হচ্ছে: আলবেনিয়া, ক্যামেরুন, চেক রিপাবলিক, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ইকুয়েডর, ইথিওপিয়া, ফিজি, গুয়াতেমালা, উত্তর মেসিডোনিয়া, মলডোভা, সামোয়া, এবং সাউথ সুদান।

তবে জাতিসংঘের এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানই ঘোষণাটিকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটি যেন স্পষ্ট করে জানাচ্ছে, ফিলিস্তিন প্রশ্নে বিশ্ব আর ধৈর্যের সীমা টেনে রাখতে রাজি নয়। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই বিপুল ভোটে কি সত্যিই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো?

আজকের প্রস্তাব হয়তো কালকেই রাষ্ট্র গঠনের দিকে নিয়ে যাবে না। কিন্তু এটি একটি অনিবার্য পথরেখা তৈরি করছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আর কেবল স্বপ্ন নয়, বরং সময়ের অপেক্ষায় থাকা এক বাস্তবতা। দেরি হতে পারে, প্রতিরোধ আসতে পারে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীনতার ঢেউ যেমন বহু দমিত জাতিকে মুক্ত করেছে, তেমনি ফিলিস্তিনের মুক্তির সম্ভাবনাও ক্রমে ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়ে উঠছে।

সবচেয়ে বড় জটিলতা এখানেই। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির অমোঘ বাস্তবতা হলো—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে তবেই জাতিসংঘের যে কোনো উদ্যোগ বাস্তবে রূপ নেয়। ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে শুধু ইসরায়েলের কৌশলগত মিত্রই নয়, বরং তার নিরাপত্তার একমাত্র প্রকৃত অভিভাবক। সামরিক সহায়তা, আর্থিক অনুদান, অস্ত্র সরবরাহ, এমনকি কূটনৈতিক ঢাল—সবই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দিয়ে আসছে। আর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তাদের ভেটো ক্ষমতা ইসরায়েলের জন্য এক অব্যর্থ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসে একাধিকবার দেখা গেছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যখনই কোনো শক্ত প্রস্তাব এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে তা আটকে দিয়েছে।

তাই সাধারণ পরিষদের বিপুল সমর্থন সত্ত্বেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশয় অটুট থাকে। নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো কিংবা ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসানে বাধ্যতামূলক কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র শুক্রবারের ভোটকে ‘সময়োপযোগী নয়’ ও ‘ভুল পদক্ষেপ’ আখ্যা দিয়েছে। এ ভাষ্য আসলে ওয়াশিংটনের অনমনীয় অবস্থানকেই প্রতিফলিত করে।

জাতিসংঘের ইতিহাসে এমন বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে এটি সবচেয়ে প্রকট। তবে এটিও সত্য—বৈশ্বিক নৈতিক চাপ, একঘরে হয়ে পড়া এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে একসময় নীতি পাল্টাতেই হয়েছে। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যায় এই বাস্তবতা।

দক্ষিণ আফ্রিকার এপারথাইডের উদাহরণই ধরা যাক। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বারবার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশ কার্যকর করেনি। অর্থনৈতিক স্বার্থ ও কৌশলগত জোট তাদের এ অবস্থানে বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জনমত এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে ওয়াশিংটনকেও অবস্থান পাল্টাতে হয়। আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ চাপ, ইউরোপের বাড়তে থাকা বিরোধিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে নাগরিক আন্দোলনের উত্তাপ—সব মিলেই হোয়াইট হাউজ অবশেষে নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে। এবং সেই পরিবর্তনই আফ্রিকার বর্ণবাদী ব্যবস্থা পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ঘটনাও একইরকম শিক্ষা দেয়। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের নৃশংসতা, বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ এবং আমেরিকার ভেতরে ছাত্র-যুবকদের রাস্তায় নেমে আসা ওয়াশিংটনকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতির চাপ যুক্তরাষ্ট্রকে অবশেষে প্যারিস শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল।

ফিলিস্তিন প্রসঙ্গেও একই চিত্র স্পষ্ট। সাধারণ পরিষদে দশকের পর দশক অসংখ্য প্রস্তাব পাস হয়েছে ফিলিস্তিনের অধিকারের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল অধিকাংশ সময়ই একঘরে থেকেছে। যদিও সেসব প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়নি, কিন্তু আন্তর্জাতিক জনমতের এক বিশাল ভিত্তি তৈরি করেছে। আজ ইউরোপীয় দেশগুলো একে একে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে—এটি সেই দীর্ঘদিনের চাপের ফল।

এই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তগুলো বলছে—হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে জাতিসংঘের নতুন দুই-রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাব আগামীকালই বাস্তবে রূপ নেবে না। কিন্তু বৈশ্বিক নৈতিক চাপ, কূটনৈতিক একঘরে হয়ে পড়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন একদিন তাকে অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য করতেই পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন হয়েছে, ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তেমনি হয়েছিল।

তবে এখানে আরেকটি বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল কেবল একটি মিত্র নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত ঘাঁটি। তেলের রাজনীতি, ইরানকে ঠেকানো, সামরিক শিল্পের বাজার—সবকিছু মিলিয়ে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশীদার। উপরন্তু, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসরায়েলপন্থি লবি অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে হোয়াইট হাউজ সহজে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ নেবে—এ আশা করা কঠিন।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রস্তাবটি একেবারে অগ্রাহ্য করেছে। তাদের রাষ্ট্রদূত এটি ‘নাটক’ আখ্যা দিয়ে বলেছে—এতে সন্ত্রাসীরা উল্লসিত হবে। দখলদারত্ব ও নিরাপত্তা নীতিতে যেভাবে কঠোর অবস্থান তারা নিয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক চাপও সহজে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারবে না।

তাহলে কি জাতিসংঘের ঘোষণাটি কেবল আরেকটি রাজনৈতিক দলিল হয়ে থাকবে? হয়তো স্বল্পমেয়াদে তাই হবে। তবে এর গুরুত্ব কম নয়। এটি বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের দেশের সম্মিলিত অবস্থান প্রকাশ করেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো শক্তি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে। উপসাগরীয় আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রস্তাব সমর্থন করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ক্রমেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে পড়ছে।

এই একঘরে হয়ে পড়ার চাপ দীর্ঘমেয়াদে তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে যদি ইউরোপ ও আরব বিশ্ব একযোগে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো কূটনৈতিক চাপ ধরে রাখে, তবে ওয়াশিংটনের পক্ষে আগের মতো নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

তবে এই প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করছে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের ওপর। প্রথমত, আন্তর্জাতিক চাপ কতটা ধারাবাহিক ও কার্যকর হয়। শুধু প্রস্তাব বা নিন্দা নয়, বিশ্বশক্তিগুলোর ওপর নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনি সমাজের ভেতরকার বিভাজন—বিশেষত হামাস ও ফাতাহর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব—তারা কতটা মেটাতে সক্ষম হয়। কারণ ভেতরে ঐক্য ছাড়া বাইরে কোনো রাষ্ট্র টিকতে পারে না; বিভক্ত নেতৃত্ব একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে দুর্বল করে তুলবে। তৃতীয়ত, ইসরায়েলি নেতৃত্ব ও তাদের মিত্ররা কতটা আপসহীন থাকে, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।

সব মিলিয়ে বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া এই উদ্যোগের তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব। কিন্তু আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা, মানবিকতার প্রশ্ন এবং ফিলিস্তিনের দীর্ঘ ইতিহাসে জমে ওঠা রক্ত-অশ্রুর প্রতি বিশ্বজাগরণের যে অভূতপূর্ব ধারা তৈরি হয়েছে, তা একদিন যুক্তরাষ্ট্রকেও নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের তাই বলে—যেখানে ন্যায় ও মানবিকতার শক্তি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও বদলে দেয়।

আজকের প্রস্তাব হয়তো কালকেই রাষ্ট্র গঠনের দিকে নিয়ে যাবে না। কিন্তু এটি একটি অনিবার্য পথরেখা তৈরি করছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আর কেবল স্বপ্ন নয়, বরং সময়ের অপেক্ষায় থাকা এক বাস্তবতা। দেরি হতে পারে, প্রতিরোধ আসতে পারে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীনতার ঢেউ যেমন বহু দমিত জাতিকে মুক্ত করেছে, তেমনি ফিলিস্তিনের মুক্তির সম্ভাবনাও ক্রমে ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়ে উঠছে।

লেখক : কলামিস্ট ও লেখক।

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article