কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা থেকে প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার জনকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ফেরত নেওয়ার সংবাদে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আনন্দ। তারা বলেছেন, নিজ দেশে যেতে পারলে আগের মতো কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে পারবেন। তবে মিয়ানমার জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দেশটির বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি যুদ্ধ করে রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করেছে, সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আলী হোসেন বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালে জীবন বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পের মধ্যে বসবাস করছি। কিন্তু ক্যাম্পের এই জীবন আর ভালো লাগছে না। আমরাও পৃথিবীর অন্য দেশের নাগরিকদের মতো নিজ দেশে বসবাস করতে চাই। সম্প্রতি ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে যে কথা আমরা শুনেছি তা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।’
উখিয়া বালুখালি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা কামাল হোসেন বলেন, প্রাণ বাঁচাতে আমরা যখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম, এরপর থেকে বলে আসছি আমরা নিরাপদে রাখাইনে ফেরত যেতে চাই। কারণ রাখাইনে আমাদের ধন-সম্পদ বাড়ি-ঘর ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছিল। এখন ক্যাম্পে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করতে হচ্ছে। ঝুপড়ি একটি-দুটি ছোট রুমে ছেলে-মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রী কত কষ্ট করে বসবাস করছি তা আমরা বুঝতেছি। তাই ক্যাম্পের জীবন ছেড়ে নিজের বাড়িঘরে থেকে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়বো। মিয়ানমার জান্তা সরকার আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে আমরা ফেরত যেতে প্রস্তুত।
আরও পড়ুন-
- ড. ইউনূসের উচ্চ প্রতিনিধি ও মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রীর বৈঠক
- এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নিতে সম্মত মিয়ানমার
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবায়ের বলেন, মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন নিপীড়নে বাস্তুচ্যুত হয়ে আমরা রাখাইন থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি, তখন থেকে এই পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারেনি। আমরা আশাবাদী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আগে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমানে মিয়ানমার জান্তা সরকার ও দেশটির বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে। এতে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা দখলে নিয়েছে। এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও আমরা মিয়ানমারে যেতে রাজি, কিন্তু জান্তা সরকারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাখাইনের এই যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে এখনো অনেক রোহিঙ্গা পরিবার নিয়ে ধাপে ধাপে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। রাখাইনে বর্তমানে যে রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের ওপর চলছে নির্যাতন ও নিপীড়ন।
পালংখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উখিয়া -টেকনাফের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সাধারণ সম্পাদক গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয়ে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। তবুও কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নিয়ে যায়নি। কিন্তু এখন নতুন করে আমরা আশার বাণী শুনছি। আমরা সেই আশার বাণীর দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। আমরাও চাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন করা হোক।
মিয়ানমার সরকার রাখাইনের সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালালে তখন ৮ লাখ রোহিঙ্গা চলে আসেন বাংলাদেশে। এর আগে আরও সাড়ে ৪ লাখ আসেন। এখন সব মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। নিবন্ধনের বাইরেও আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গার বসবাস এসব ক্যাম্পে। কিন্তু গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি।
এরইমধ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে শুক্রবার একটি বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ। এসময় খলিলুর রহমানকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ জানান বাংলাদেশে আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেবে। প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে শুক্রবার দেওয়া এক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এফএ/জেআইএম