জিএস প্রার্থী ফরহাদের বিষয়ে আপিল শুনানিতে পাল্টাপাল্টি যুক্তি

3 hours ago 6

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। তবে, কেউই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। বরং নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। শুরুর পর মাঝে ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে এ শুনানি।

ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী শুনানিতে বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ মনোনীত প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো ঠিক না।

এসময় তিনি আরও বলেন, এস এম ফরহাদ নামে ফারসি বিভাগে আরও একজন শিক্ষার্থী ছিলেন, যিনি ছাত্রলীগের পদধারী। সেই ফরহাদ আর এই ফরহাদ এক না, সম্পূর্ন ভিন্ন একজন।

তিনি বলেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে যে ছবি দেখানো হয়েছে, তা ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি হওয়ার পরের সময়ের। সেটি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। এস এম ফরহাদ জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

শুনানি শেষে বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আদেশ দেন। যেখানে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেওয়া চেম্বার জজ আদালতের আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরই হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।

আদালতে রিটকারীর পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ও ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন।

শিশির মনির শুনানিতে বলেন, ডাকসু নির্বাচনে জিএস প্রার্থী এসএম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে গত ২৮ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটে তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে সম্পৃক্ততার অভিযোগ করা হয়। এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের সব প্রস্ততি সম্পন্ন হয়েছে। রিটকারী বি এম ফাহমিদা আলম বামজোটের মনোনীত প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক প্রার্থী, যার বিরুদ্ধে রিট করা হয়েছে তিনি জিএস প্রার্থী। সুতরাং রিটকারীর ব্যক্তিগতভাবে এখানে সংক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নেই। তাই এ রিট চলতে পারে না। অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে রিট করা হয়েছে।

এ আইনজীবী আরও বলেন, জিএস প্রার্থী ফরহাদ ২০২২ সালে ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন, এমন দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে করা হয়নি। এটি হাইকোর্টে এসে বলা হচ্ছে। এ অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি ফটোকপি ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই।

তিনি বলেন, বরং আমরা দেখেছি জুলাই বিপ্লবের সময় ফরহাদ শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে ভিপিপ্রার্থী সাদিক কায়েম বলেছেন, ২০১৮ সালে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় ফরহাদকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

বর্তমানে আরেক ভিপি প্রার্থী আবুদল কাদের বলেছেন, এসএম ফরহাদ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় শিবিরের ঢাবি শাখার সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফারসি বিভাগের এক ছাত্রলীগ কর্মী এস এম ফরহাদের সঙ্গে ডাকসুর জিএস প্রার্থী সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের এস এম ফরহাদকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ ফরহাদ এবং সেই ফরহাদ একই ব্যক্তি নন।

শিশির মনির বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমরা চেম্বার জজ আদালতের আদেশ বহাল রাখার আর্জি জানাচ্ছি।

রিটের পক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম শুনানিতে বলেন, একই অভিযোগে অন্যদের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। এসএম ফরহাদের বিষয়ে প্রার্থিতা বহাল আছে, এটা বৈষম্যমূলক। এসময় আদালত বলেন, (ছাত্রলীগে ফরহাদের সংশ্লিষ্টতা) বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে। তখন আহসানুল করিম বলেন, না, এটা নিয়ে বিতর্ক নেই। এস এম ফরহাদ ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। তবে আমি আইনজীবী হিসেবে নিশ্চিত না।

তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে পারে, তিনি ছাত্রলীগে ছিলেন কি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি নিশ্চিত হতে পারে। যদি ছাত্রলীগে তার সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারেন। আমরা হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন চাই। আমরা নির্বাচন স্থগিত চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বল্প সময়েও ফরহাদের বিষয়ে তদন্ত করে দেখতে পারে।

ফরহাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী আদালতে বলেন, এস এম ফরহাদ গণমাধ্যমে বলেছেন, তিনি কখনো ছাত্রলীগে সিভি দেননি। ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ছাত্রলীগের সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়ে যে ছবি দেখানো হয়েছে, তা ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি হওয়ার পরের সময়ের। সেটি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। ফরহাদ জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি শুনানিতে আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের তালিকা দাখিল করেছেন, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে ফরহাদের নাম আছে। এছাড়া ছাত্রলীগের সঙ্গে ফরহাদের জড়িত থাকার বিষয়ে যে কাগজ দেখানো হয়েছে তা ফটোকপি। তা অরিজিনাল কপিও নয়। এর কোনো সোর্স তারা উল্লেখ করেননি। সর্বোচ্চ আদালত এমন ডকুমেন্ট কেন বিবেচনায় নেবেন।

তিনি বলেন, ফরহাদ ছাত্রলীগ করেন, এ অভিযোগটাই বিতর্কিত। ছাত্রলীগে সম্পৃক্ততার অভিযোগ যাচাই করা আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। প্রতিটি হল ও ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ফরহাদের বিষয়ে সেখানে কোনো অভিযোগ করা হয়নি।

ইমরান বলেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাচনী আপিল বোর্ড ও সর্বশেষ ভিসির কাছেও যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ফরহাদের বিষয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ করা হয়নি, সরাসরি হাইকোর্টে আসা হয়েছে, যা বিবেচনার এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই।

তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে উদ্দশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসএম ফরহাদের বিরুদ্ধে এ রিট করা হয়েছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র মতে, নির্বাচন নিয়ে আপত্তি থাকলে নির্বাচনের তিনদিন পর আপিল করার সুযোগ আছে। রিটকারী সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি।

এর আগে এ সংক্রান্ত রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত সোমবার ডাকসুর নির্বাচন প্রক্রিয়া ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকার কার্যক্রম স্থগিত করে আদেশ দেয় হাইকোর্ট। ফলে আটকে যায় ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচন। হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেম্বার আদালতে আবেদন করে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে চেম্বার আদালত নিয়মিত সিএমপি বা সিভিল মিসলেনিয়াস পিটিশন (দেওয়ানি বিবিধ আবেদন) না করা পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। ফলে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে বাধার দেয়াল অপসারিত হয়।

সেই রিটের শুনানি ও আদেশের পথ ধরে বিষয়টি চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়। এরপর সম্পূরক কার্যতালিকায় আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে এবং শুনানি হয়।।

ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ও বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো পৃথক প্যানেল ঘোষণা করেছে। পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে এবার প্রায় ১০টি প্যানেল ঘোষণা করা হয়েছে।

এফএইচ/এমকেআর/এএসএম

Read Entire Article