জুলাই সনদ নারীবর্জিত, আমরা তা গ্রহণ করি না: শিরীন পারভীন হক

2 hours ago 3

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেছেন, জুলাই সনদের পুরো প্রক্রিয়াটা নারীবর্জিত ছিল, তাই তিনি এবং তার কমিশন এটি গ্রহণ করেন না।

তিনি বলেন, ‘সেই দিন দক্ষিণ প্লাজায় (জুলাই সনদ সইয়ের দিন) আমি উপস্থিত ছিলাম। তখনই আমি পোস্ট করেছি যে, আজ আবারও সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পুরুষ শাসন কায়েম হলো। কোনো নারীর কথা নেই, কোনো নারীকে রাখা হয়নি, কোনো নারী সংগঠনকে ডাকা হয়নি।’

শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘এটি আমাদের শুধু ব্যথিতই করেনি, বরং গভীর উদ্বেগও তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমার ভয় রয়েছে। তাই, আপনারা যতই বাস্তবায়নের কথা ভাবুন, আমি এই সনদ গ্রহণ করি না। এ সনদের প্রতি আমার কোনো সম্মান নেই।’

শনিবার (৮ নভেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘নারীর কণ্ঠে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সহযোগী সংগঠন জাতীয় নারী শক্তি এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।

শিরীন হক বলেন, ‘আমরা জলে ভেসে আসিনি। আমাদের বড় বোনরা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে ১৯৭০ সাল থেকে সংগ্রাম করছেন, আর আমরা ১৯৮৪ সাল থেকে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আমরা লড়াই করেছি। তাই নারীদের এভাবে উপেক্ষা করা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের প্রতিবাদ স্পষ্ট, আমরা জুলাই সনদ গ্রহণ করি না।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, ৫ আগস্টে আমাদের প্রত্যাশা আকাশ ছুঁয়েছিল। যে বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা রাস্তায় লড়াই করেছে, বাস্তবে কারও অঙ্গহানি হয়েছে, কেউ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আজও অনেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে বা বাড়িতে চিকিৎসাধীন। কিন্তু তারা কেন আন্দোলনে নেমেছিল? কারণ তারা একটি সুন্দর, ভালো এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল।’

আরও পড়ুন
রাজনৈতিক দলে নারী মনোনয়ন ৫ শতাংশে নেমেছে: তাসলিমা আখতার
জুলাই সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকবে না: নাহিদ ইসলাম

‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের সময় মূল লক্ষ্য ছিল এই বাচ্চাদের লড়াইকে সামনে রেখে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের জন্য নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেদনেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

নারী বিষয়ক সংস্তার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘কমিশন চার মাস ধরে কাজ করেছে, ঢাকার বাইরে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে পরামর্শ সভা করেছে। তাদের চাহিদা, দাবি ও প্রত্যাশা সংগ্রহ করে প্রস্তাবগুলো তৈরি করা হয়েছে। কমিশন মোট ৪২৩টি প্রস্তাব করেছে, যা তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১. অন্তর্বর্তী সরকার অস্থায়ী অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব; ২. পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের বিবেচনার জন্য প্রস্তাব এবং ৩. দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব।’

শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘নারীরা চায় মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা এবং নাগরিক অধিকার। নাগরিক হিসেবে বিয়ে করার অধিকারসহ সমাজের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়া উচিত।’

৫ আগস্টের আন্দোলনের ম্যান্ডেট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেসব অনাচার, হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে, তার সুষ্ঠু বিচার চাই। বিচার প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান ও চলমান রাখতে হবে। সংস্কার শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রে প্রয়োজন এবং অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচনও প্রয়োজন।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বিভিন্ন কমিশনের কাজের মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের সময় দেয়নি।’

শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘জুলাই সনদে গণভোটের মাধ্যমে ৪৮টি বিষয়ের বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। ৪৮টি বিষয় একসঙ্গে আমি ধারণ করতে পারি না। আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু আমার ভোটারদের অধিকাংশ শিক্ষিত নন। তাহলে তারা কোন বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বলবে, কোনটিতে ‘না’; কীভাবে ঠিক করা হবে? ধরুন, আমার কাছে ৪৮টির মধ্যে ৩০টি গ্রহণযোগ্য, তাহলে আমি কি সেগুলো আলাদা করে হ্যাঁ বলবো, আর বাকি ১৮টিতে না? এইভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব কি? এটা একদমই উদ্ভট পরিস্থিতি।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন রাজাকারের সন্তানরা কোথায় থাকবে, তখন রোকেয়া হলে মেয়েরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, কিন্তু কোনো টেবিলে, কোনো নীতিনির্ধারণে তাদের উপস্থিতি ছিল না। একটার পর একটা অধ্যাদেশ পাস হয়েছে।’

‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা কি তিন পা এগিয়ে চার পিছিয়ে গেলাম? ১৯৭২ সালে ৩০০ আসনের সংসদ ছিল, এখন জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ধারণা, ৬০০ আসনের সংসদ হওয়া উচিত এবং ৩০০ সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে।’ যোগ করেন তিনি।

শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘আমরা আশা করি নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা যা করতে পারবে, তা করবে। তারা গণতন্ত্র এবং মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হবে, সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করবে। ন্যায়পালের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে এবং নির্বাচনের ইশতেহারে স্থান পাবে।’

জেপিআই/ইএ/জেআইএম

Read Entire Article