জেনারেল ওয়াকারে কে কী শুনেছি-দেখেছি-বুঝেছি?

3 hours ago 5

ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউডে যা বলার সবই বলেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। কম কথার মানুষ পরিমানে বেশিই বলেছেন। তাও আকার-ইঙ্গিত বা ইশারায় নয়, একদম প্রকাশ্যে। প্রথম জাতীয় শহীদ সেনা দিবসে ‘রাওয়া’ আ‌া‌য়ো‌জিত স্মরণ সভার আগের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সাভারেও কয়েক লাইনে কিছু কথা বলেছেন। দেশে নির্বাচিত সরকার ও শৃঙ্খলা ফিরে আসার আগপর্যন্ত সেনাবাহিনীকে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে মন্তব্য করে বলেছেন, পেশাদারিত্বের মাধ্যমে এ কাজ করতে হবে। সাভার সেনানিবাসে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ফায়ারিং প্রতিযোগিতা-২০২৫’–এর সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেন জেনারেল ওয়াকার।

বক্তব্যের এক পর্যায়ে এও বলেছেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম তাড়াতাড়ি সেনানিবাসে ফেরত আসতে পারব। কিন্তু কাজটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দেশ ও জাতির জন্য এই সার্ভিসটা (সেবা) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যত দিন না আমরা একটা নির্বাচিত সরকার না পেয়ে যাই, দেশ একটা শান্তি-শৃঙ্খলার মধ্যে আসে, তত দিন পর্যন্ত এই কাজটা ধৈর্যের সঙ্গে করে যেতে হবে। কোনো উচ্ছৃঙ্খল কাজ করা যাবে না। বল প্রয়োগ করা যাবে না। মাঝে মাঝে এ কাজগুলো করতে গিয়ে কিছুটা বল প্রয়োগ হয়ে যায়। বল প্রয়োগ করতে গেলেও একেবারে প্রপোরসনেট (যতটুকু না করলেই নয়) যেন হয়। যত কম বল প্রয়োগের মাধ্যমে কাজগুলো করা যায়, ততই ভালো।

ঘটনা, সময় এবং পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় গুরুত্ব পেয়েছে তার রাওয়া ক্লাবে দেয়া বক্তব্য। সেখানে তিনি সবাইকে সতর্ক-সাবধান-হুঁশিয়ারি যে ভাষাতেই হোক সময়োচিত দশ কথার কয়েকটি বলতে ছাড়েননি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছেন। নির্বাচনের কথাও বলেছেন। নিজের উচ্চাকাঙ্খা নেই তাও জানিয়েছেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও আলোচনার ঝড় বাইছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের হত্যাকাণ্ডে নিহত সামরিক কর্মকর্তাদের স্মরণে রাওয়ায় ওই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। সেখানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের মুখের ভাষার সঙ্গে শরীরের ভাষার বেশ স্পষ্টতা। গত ক’দিন স্যোশালমিডিয়ায় তা ঘুরছে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে। বক্তব্যে কয়েক বার 'সতর্ক' শব্দের ব্যবহার করেছেন তিনি। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশাবাদের কথা আছে। খোলাসা করে বলেছেন, 'আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার এদিকে হেল্প করবে।'

এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। সে প্রসঙ্গও টেনেছেন সর্বশেষ বক্তব্যে। জেনারেল ওয়াকারের খোলাসা বক্তব্যের পর এখন আর আকার-ইঙ্গিতের তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। পরিস্থিতি অনেকটা পরিস্কার। তারপরও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বেশ ফের। যে যার সুবিধা মতো শুনেছেন। বুঝেছেনও নিজেদের মর্জি মতো। রাজনীতিকদের মতো ইনিয়েবিনিয়ে নয়, সোজাসিধা বলেছেন, আপনারা এগুলো (শহীদ সেনাদের বিভৎস ছবিগুলি) ছবিতে দেখেছেন, কিন্তু এগুলো আমার চাক্ষুষ দেখা। আমি চাক্ষুষ স্বাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার। একটা জিনিস আমাদের পরিষ্কার মনে রাখতে হবে, এই সমস্ত বর্বরতা কোনো সেনা সদস্য দ্বারা ঘটেনি, এ সমস্তটাই বিজিবি সদস্যদের দ্বারা ঘটেছে। ফুল স্টপ। এখানে কোনো ইফ বা বাট নাই; এখানে যদি ইফ বা বাট আনেন, তাহলে সঠিক বিচারের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে না।

বক্তব্যের আরেক জায়গায় বলেছেন, আমার উপদেশ গ্রহণ করলে আপনারা লাভবান হবেন, এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি। আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের নিজেদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যম সমাধান করব। এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। তা না হলে নিজের ক্ষতিই হবে। … ২০০৯ সাল থেকে যারা শাস্তি পেয়েছেন, কেউ কেউ বলছেন তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। সেই বোর্ড প্রথম ফেইজে ৫১ জনের ব্যাপারে রিকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। আমি তা গ্রহণ করেছি। নেভি এয়ারফোর্সও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। … আমার স্ট্যান্ড পয়েন্ট হচ্ছে— যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য শাস্তি পেতেই হবে। কোনো ছাড় হবে না। বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ইট ইজ অ্যা ডিসিপ্লিন ফোর্স। …আপনারা আমার কথায় হয়ত খুশি হবেন না। কিন্তু পরিষ্কার করে জেনে রাখুন, আমার অন্য কোনো আকাঙ্খা নাই। আমার একটাই আকাঙ্খা, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি কাটানো। … দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ, আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। তারা জানে এ পরিস্থিতিতে অপরাধ করে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা যদি সংঘবদ্ধ থাকি। তাহলে এ সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হবে। … পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী অপরাধ যেমন করেছে তেমনি দেশের স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু অপরাধ যারা করেছে, তাদের বিচার হবে। হতে হবেই। নাহলে সেই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। প্রত্যক দোষীকে বিচারের আওতায় আনতেই হবে। … ডক্টর ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশটাকে ইউনাইটেড করে রাখতে। উনাকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন। আমরা একসাথে ইনশাআল্লাহ কাজ করে যাবো।

দশকথার আরেক কথায় বলেছেন, আমরা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, হানাহানি বাদ দিয়ে একসাথে ইউনাইটেড হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন সতর্ক করা হয়নি! আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসাথে কাজ করতে না পারেন, কাটাকাটি, মারামারি করেন, তাহলে এ জাতি কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।‘ সতর্কতা-সাবধানতা, হুমকি বা হুঁশিয়ারি, যে যে ভাবেই নেন জেনারেল ওয়াকার বলা আর বাকি রাখেননি। তার কঠিন সত্য উচ্চারণের মাঝে বুঝবানদের জন্য অনেক বার্তা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালায়ন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কিছু ছাত্র সমন্বয়ক, রাজনৈতিক দল, সুশীল, বুদ্ধিজীবীসহ কিছু মহলে বোধ থাকতেও মাঝেমধ্য বোধহীনতা স্পষ্ট। কথার খই ফোটানোরও একটি মহাধুম। আগে সংস্কার না নির্বাচন, আগে জাতীয় না স্থানীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনসহ কথামালা এবং তত্ব আওড়ানোর হিড়িক। সেইসঙ্গে অঘটন তো আছেই। এরপরও জাতীয় ঐক্য নিয়ে তামাশা।

এর মাঝেই তিতা ও কঠিন কথার অবতারনা সেনাপ্রধানের। যা এখন দেশটির রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে কী বার্তা দিলেন, এ নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। নানা গুঞ্জনও। যে যার মতো নানা উপাদানও বের করছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা- ছোড়াছুড়ি, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার বিষয় এবং এমনকি দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সতর্ক করার সময় তার মুখায়ব এবং শারীরিক ভঙ্গির মাঝে অবাক হওয়ার মতো বিষয়ও ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের গত ছয় মাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান যে সব বক্তব্য দিয়েছেন, সে সব বক্তব্যের সঙ্গে সর্বশেষ বক্তব্যের তফাৎ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষের কাছেও ছিল দৃশ্যমান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার শাসনের পতনের দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সেনাপ্রধান বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার সেই বক্তব্যেই জানা গিয়েছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয় এবং সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে। সেদিনের বক্তব্যে ভঙ্গি ও ভাষা এমন ছিল না। তাই তার ২৫ ফেব্রুয়ারির বক্তব্য কেবল শোনা নয়, দেখাও দরকার। শেষে কিন্তু তিনি এও বলেছেন, আজ অনেক কথা বলে ফেললাম। বলা হয়ে উঠছিল না।

অন্তর্বর্তী সরকারের গত ছয় মাস, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অযাচিত কাজকর্ম, জুলাই বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের বাচন-বচনসহ কিছু কারনে জনমনে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সে কারণে সবাইকে সতর্ক করে বক্তব্য দিতে হয়েছে সেনাপ্রধানকে। তাকে বলতে হয়েছে, নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। এমন এক সময় সেনাপ্রধান এ ধরনের বক্তব্য দিলেন, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে। আবার ছাত্রদের নতুন দলের অভিষেকও ঘটেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সংস্কার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এই দুই দলের মত বিরোধ অন্যান্য দলের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। এসব ইস্যুতে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান। তাদের অনুসরনে অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিতর্ক, বিরোধ বা বিভেদের কারণে নানারকম সংকট তৈরি হচ্ছে। ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে'- এমন শঙ্কা তিনি কেন ব্যক্ত করলেন? –এ প্রশ্ন রয়েছে কারো কারো। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি অ্যালার্ম দিয়েছেন।জেনারেল ওয়াকার যে অবস্থানে আছেন, সেখান থেকে এ সংক্রান্ত অনেক কিছু বেশি উপলব্ধি করা যায়, জানাও যায়। বাইরে থেকে সেভাবে জানার সুযোগই নেই। জেনারেল ওয়াকারের সেই উপলব্ধিটা প্রকাশ করা সবার জন্য অবশ্যই একটি দামী তথ্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা থেকে তার এ সতর্কতার তথ্যের সঙ্গে সম্ভাব্য পরিণতির কথাও জানান দেয়া সবার জন্য মঙ্গলের।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article