‘আমরা প্রতিদিন মৃত্যুভয় নিয়ে মাছ ধরতে যাই। মনে হয়, হয়তো আজ ফিরতে পারব না। দস্যুরা টাকা চাইলে না দিলে গুলি করে মেরে ফেলে।’ এভাবেই নিজের ভয় ও শঙ্কা কথা জানালেন সুন্দরবনের জেলে শরিফুল ইসলাম।
জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কয়রার জেলেরা প্রতিদিন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরার জন্য তাদের জীবন বাজি রাখতে হয়। আর ফিরতে হলে অনেক সময় গুনতে হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।
৬৫ বছরের আব্দুস সাত্তার, শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও সংসারের অভাব মেটাতে তিনি এখনো সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান।
তিনি বলেন, ‘গত ২৪ আগস্ট মাছ ধরতে সুন্দরবনে যাই। পরদিন বনদস্যুরা আমাকে আটক করে। তারা প্রথমে ২৫ হাজার টাকা দাবি করে। অনেক দর-কষাকষির পর ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ হয়। ধারদেনা করে পরিবার টাকা পাঠালে বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে মুক্তি পাই।’
সাত্তারের অভিজ্ঞতা একক ঘটনা নয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, একই সময় অন্তত সাতজন জেলে মুক্তিপণের ফাঁদে পড়ে টাকা দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছেন। কিন্তু এসব ঘটনার বেশিরভাগই সামনে আসে না। বর্তমানে সুন্দরবনে ৩টি দস্যু বাহিনী সবচেয়ে সক্রিয়, খোকাবাবু বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী ও কাজল বাহিনী। এর মধ্যে খোকাবাবু ও দুলাভাই বাহিনীর নাম শোনা গেলেও সম্প্রতি কাজল বাহিনীর নাম সামনে এসেছে।
এদিকে, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুন্দরবনের জলদস্যু কাজল-মুন্না বাহিনীর তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে যশোরের অভয়নগর থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় মুক্তিপণের ৭৪ হাজার টাকা, মোবাইল ও বিকাশ সিম জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তাররা হলেন সাহা সুব্রত মল্লিক (৪৩), বিপ্লব রায় (৩২) ও লক্ষণ বিশ্বাস (৭২)। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিম্মি দুই জেলে আব্দুস সালাম (২৫) ও বিজয় ধীবরকে (২৭) সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করা হয়।
বাঘ, কুমির, হরিণ ও হাজারো প্রজাতির মাছ-ঝিনুকের এ বন কেবল প্রকৃতির জন্য নয়, হাজারো জেলের জীবিকার একমাত্র ভরসাস্থল। কিন্তু আজ সেই সুন্দরবনই জেলেদের কাছে মৃত্যুফাঁদ। নদীর জোয়ার-ভাটা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা বাঘের ভয় নয়, এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্ক হলো বনদস্যুরা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিপণের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি নৌকা সুন্দরবনে প্রবেশের আগে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি তথাকথিত ‘কার্ড’ সংগ্রহ করতে হয়। এ কার্ড আসলে দস্যুদের কাছ থেকে বেঁচে ফেরার ফি। কিন্তু একবার টাকা দিলেই মুক্তি মেলে না। কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর আবার নতুন অজুহাতে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনীমুখার জেলে আরিফুল আলম, তিনি দস্যুদের ভয়ে এখন বাড়ি ছাড়া।
তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করা খোকাবাবু আবার দস্যুতায় ফিরেছে। সম্প্রতি আমার বড় ভাইকে ধরে ৪ লাখ টাকা দাবি করে। দুই লাখ টাকা বিকাশে পাঠানোর পর ভাইকে ছাড়ে। বাকি টাকা না দেওয়ায় আমাকে এখন বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাই আমি শহরে পালিয়ে আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দস্যুদের ভয়ে আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না। থানায় অভিযোগ করলেও মামলা হয় না। উল্টো দস্যুরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের তাড়া করে।’
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দস্যুরা সরাসরি টাকা নেয় না। স্থানীয় এজেন্ট ও বিকাশের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়।
জেলেরা অভিযোগ করেছেন, গাবুরার চাঁদনীমুখার মহিউদ্দিন নামের একজন খোকাবাবুর বাহিনীর হয়ে কার্ড সরবরাহ করেন। আবার চাঁদনীমুখার মনিরুল টেলিকমের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়।
মনিরুলের স্ত্রী ও দোকানের পরিচালক সুফিয়া বেগম স্বীকার করে বলেন, কয়েকজন জেলে আমার দোকান থেকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েছে। তবে কার কাছে পাঠিয়েছে সেটা আমার জানা নেই।
স্থানীয় জেলেরা অভিযোগ করেন, চাঁদা না দিলে দস্যুরা নৌকা আটক করে জেলেদের গাছে বেঁধে মারধর করে। অনেক সময় দিনের পর দিন আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করে। কারও কারও পরিবার ঘরবাড়ি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে বাধ্য হয়।
দস্যুতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ জেলেদের।
শ্যামনগর থানার ওসি হুমায়ুন বকর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে বন বিভাগ জানায়, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।
বুড়িগালিনী স্টেশনের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। আমরা এক অভিযানে ১৩ জন জেলেকে উদ্ধার করেছি। তবে দস্যুরা পালিয়ে যায়।’
সাতক্ষীরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মুকিত খান বলেন, ‘সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি দুর্বল হওয়ার সুযোগে তারা নতুন করে দস্যুতায় ফিরেছে।
সামাজিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দস্যুদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ আছে। বিকাশ লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করা গেলে চাঁদাবাজি অনেকটা কমবে। ভুক্তভোগী জেলেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে সরকার ঘোষিত আত্মসমর্পণ কর্মসূচিতে সুন্দরবনের ২৬টি দস্যু বাহিনীর প্রায় ৩৩২ জন সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই পুরনো বাহিনীর সদস্যরা আবারও সক্রিয় হয়ে পড়ে।