মানুষের ইতিহাসে টাকার জন্য লড়াই, পরিশ্রম ও প্রতিযোগিতা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। টাকাই যেন বেঁচে থাকার প্রতীক, নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। আমরা বিশ্বাস করি, অর্থ থাকলেই জীবন সহজ হবে, স্বপ্নগুলো পূরণ হবে, আর তাতে সুখও নিশ্চিত আসবে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই অন্যরকম। আধুনিক মনোবিজ্ঞান, দর্শন, এমনকি জীবনের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যও বলছে — টাকা প্রয়োজনীয়, কিন্তু সুখের নিশ্চয়তা নয়। বরং সুখ একটি গভীর মানসিক অবস্থান, যা আসে আত্ম-চেতনা, উদ্দেশ্য ও কৃতজ্ঞতা থেকে।
টনি রবিন্স, যিনি সারা পৃথিবীতে “জীবন পরিবর্তনের গুরু” হিসেবে পরিচিত, বলেন— “Success without fulfillment is the ultimate failure.” অর্থাৎ সফলতা, অর্থ, খ্যাতি— এসব যদি তোমার মনে তৃপ্তি না আনতে পারে, তাহলে সেটা ব্যর্থতাই। রবিন্স নিজেও বহু কোটিপতি উদ্যোক্তার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং দেখেছেন, তাদের অনেকেই অর্থে ভরপুর হলেও মানসিকভাবে নিঃস্ব। কেউ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছেন, কেউ আবার জীবনের অর্থই ভুলে গেছেন। তিনি বলেন, মানুষ প্রায়ই ভাবে টাকা পেলে সে সুখী হবে, কিন্তু বাস্তবে সুখই সেই মানসিক অবস্থা যা আমাদের কাজকে অর্থপূর্ণ করে তোলে এবং টাকাকে মূল্য দেয়।
জিম রন, টনি রবিন্সের পরামর্শদাতা, একবার বলেছিলেন— “Happiness is not something you postpone for the future, it is something you design for the present.” অর্থাৎ সুখ ভবিষ্যতের কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একধরনের নকশা যা আজ, এই মুহূর্তেই তৈরি করতে হয়। জিম রন শেখাতেন, ধনীরা টাকার মালিক, কিন্তু জ্ঞানীরা অভিজ্ঞতার মালিক। যদি তোমার মনে কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও মানসিক শান্তি না থাকে, তাহলে যত অর্থই তোমার হাতে আসুক না কেন, তা তোমার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
সুখ এমন এক সম্পদ যা তুমি টাকায় কিনতে পারবে না, কিন্তু সঠিক মনোভাব ও জীবনদৃষ্টিতে তৈরি করতে পারবে। সুখ মানে কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, আত্ম-স্বীকৃতি, এবং অন্যের জীবনে আলো ছড়ানোর ইচ্ছা। যখন তুমি এগুলো অর্জন করবে, তখন দেখবে টাকাও তোমার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠছে।
অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। তাঁর মতে, আধুনিক মানুষ সুখকে ভুল পথে খুঁজে বেড়াচ্ছে— বাহ্যিক আরাম, বিলাসিতা ও খ্যাতির ভেতর। কিন্তু সুখ হলো মনের একধরনের সুর, যা আসে ভালোবাসা, সৃষ্টিশীলতা ও সমাজে অবদান রাখার মধ্য দিয়ে। রাসেল বলেছিলেন, “The good life is one inspired by love and guided by knowledge.” এই ‘ভালো জীবন’-এর মূলতত্ত্ব হলো ভালোবাসা ও জ্ঞান। টাকার উপস্থিতি এখানে উপকারী হতে পারে, কিন্তু সেটি কখনও প্রধান শর্ত নয়। তিনি আরও বলেন, যাদের জীবনের উদ্দেশ্য শুধু অর্থ, তারা প্রায়ই একঘেয়েমি ও শূন্যতার শিকার হয়— কারণ টাকা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু মানসিক প্রশান্তি চিরন্তন।
অন্যদিকে, নেপোলিয়ন হিল তাঁর বিখ্যাত বই Think and Grow Rich-এ বলেন, “Whatever the mind can conceive and believe, it can achieve.” তিনি টাকাকে লক্ষ্য হিসেবে নয়, বরং মানসিক শক্তির প্রতিফলন হিসেবে দেখেছেন। হিলের মতে, ধন বা সফলতা আসে সঠিক চিন্তা, লক্ষ্য ও বিশ্বাস থেকে। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে সতর্ক করেছেন— যদি সেই লক্ষ্য শুধু অর্থ হয়, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ দেবে না। তিনি লিখেছেন, “If you don’t find riches in your heart, you will never find them in your bank.” অর্থাৎ, অন্তরের সমৃদ্ধি ছাড়া বাহ্যিক সম্পদ কখনও শান্তি আনতে পারে না।
এই দার্শনিকদের চিন্তাধারা আমাদের শেখায় যে সুখের মূল উৎস বাইরের জগতে নয়, আমাদের ভেতরে। টাকা সেই সুখকে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু সৃষ্টি করতে পারে না। তুমি যদি নিজের মূল্যবোধ, লক্ষ্য ও ভালোবাসাকে না বোঝো, তাহলে যত অর্থই উপার্জন করো না কেন, তা হবে এক অগভীর নদীর মতো— ঝলমলে, কিন্তু গভীরতাহীন।
টনি রবিন্স প্রায়ই বলেন, “The secret to living is giving.” জীবনের আসল আনন্দ আসে যখন তুমি তোমার ক্ষমতা, সময়, বা সম্পদ অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করো। তিনি নিজেই নিজের আয়ের বড় অংশ সমাজসেবায় ব্যয় করেন, কারণ তিনি জানেন, সুখ মানে শুধু নিজের জন্য অর্জন নয়, বরং অন্যের জীবনেও আলো ছড়ানো। অনেকেই মনে করে দান মানেই অর্থ দেওয়া, কিন্তু রবিন্স বলেন, “দান মানে হলো অংশগ্রহণ”— কারও পাশে থাকা, একটি হাসি উপহার দেওয়া, কাউকে অনুপ্রাণিত করা — এগুলোও দানেরই রূপ।
জিম রনও একইভাবে বলেছিলেন, “You don’t get paid for the hour, you get paid for the value you bring to the hour.” এই কথার মধ্যে গভীর জীবনদর্শন লুকিয়ে আছে। যদি তোমার জীবনে কাজের আনন্দ থাকে, অবদান রাখার মানসিকতা থাকে, তাহলে তুমি টাকাকে একধরনের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পাবে, কিন্তু যদি শুধু টাকার জন্য কাজ করো, তাহলে সেটা কখনও পূর্ণতা আনতে পারবে না।
রাসেলের মতে, আধুনিক সমাজে মানুষের উদ্বেগের বড় কারণ হলো তুলনা। আমরা অন্যের বাড়ি, গাড়ি, পোশাক দেখে নিজেদের অভাব অনুভব করি। কিন্তু তিনি মনে করতেন, সুখ তখনই সম্ভব যখন মানুষ নিজের জীবনের সঙ্গে নিজের সঙ্গেই তুলনা করবে— আমি গতকাল থেকে কতটা উন্নত হয়েছি, আমি কতটা কৃতজ্ঞ হতে পেরেছি। টাকার প্রতিযোগিতা যত বাড়ে, ততই মনের শান্তি কমে যায়।
নেপোলিয়ন হিলের কথায়, “Success comes to those who become success conscious.” কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে যোগ করেন— “Happiness comes to those who are harmony conscious.” এই ‘হর্মনি’ বা সুরের বোধই আসলে সত্যিকারের সম্পদ। তোমার মন, শরীর ও আত্মা যদি সুষম হয়, তাহলে সামান্য অর্থও তোমাকে আনন্দ দিতে পারে।
আমরা প্রায়ই দেখি, কেউ কেউ সীমিত আয়েও হাসিখুশি জীবন যাপন করে, আর কেউ কোটি টাকার মালিক হয়েও অশান্তিতে ডুবে থাকে। পার্থক্যটা টাকায় নয়, মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। যারা সুখকে জীবনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করে, তারা অর্থকে ব্যবহার করে জীবন গড়ে, আর যারা সুখকে অর্থের ফল হিসেবে ধরে, তারা অর্থের দাসে পরিণত হয়।
এই যুগে টাকার প্রলোভন ও প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া, সমাজের চাপ— সব কিছু আমাদের বোঝায়, তুমি যত বেশি অর্জন করবে, তত বেশি সুখী হবে। কিন্তু বাস্তবে সেই দৌড়ের শেষ নেই। যখন তুমি নতুন গাড়ি কিনবে, তখনই দেখবে অন্যের গাড়ি আরও দামি। সুখ তখন আর লক্ষ্য থাকে না, বরং এক অদৃশ্য মরীচিকা হয়ে পড়ে।
তাই সুখের সত্যিকারের যাত্রা শুরু হয় ভিতর থেকে। শুরু হয় আত্মচেতনা থেকে— আমি কে, আমি কী চাই, কেন চাই। যদি তুমি নিজের উদ্দেশ্য জানো, যদি তোমার কাজের মধ্যে অর্থপূর্ণতা (Meaningfulness) থাকে, তাহলে টাকাও তোমাকে আনন্দ দেবে, কারণ তখন সেটা তোমার উদ্দেশ্যের অংশ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলো, তবে টাকাও তোমাকে হারিয়ে দেবে।
টনি রবিন্স এক জায়গায় বলেছেন, “People are not lazy, they simply have impotent goals — goals that do not inspire them.” অর্থাৎ মানুষ অলস নয়, তারা কেবল এমন লক্ষ্য স্থির করে যা তাদের প্রাণ জাগাতে পারে না। তাই তিনি বলেন, সুখী হতে হলে এমন লক্ষ্য বেছে নিতে হবে যা তোমার আত্মাকে জাগিয়ে তুলবে— অর্থ নয়, অর্থবোধের লক্ষ্য।
শেষ পর্যন্ত, সুখ এমন এক সম্পদ যা তুমি টাকায় কিনতে পারবে না, কিন্তু সঠিক মনোভাব ও জীবনদৃষ্টিতে তৈরি করতে পারবে। সুখ মানে কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা, আত্ম-স্বীকৃতি, এবং অন্যের জীবনে আলো ছড়ানোর ইচ্ছা। যখন তুমি এগুলো অর্জন করবে, তখন দেখবে টাকাও তোমার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠছে।
কারণ, একথা সত্যি যে—
টাকা তোমাকে সুখ দিতে পারে না, যদি তুমি না জানো কীভাবে সুখী হতে হয়।
লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এএসএম

5 hours ago
7








English (US) ·