টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শুনলেই অনেকে ভাবেন, এ বিভাগে শুধু পোশাক বানানো শেখানো হয়। অথচ এর ক্ষেত্র যে কতটা বিস্তৃত, তা অনেকেই জানেন না। সাধারণ পোশাক থেকে শুরু করে মেডিকেলের উপকরণ, অটোমোবাইল, মহাকাশ, জিও টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন সেক্টরে টেক্সটাইলের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
উন্নত দেশগুলোতে মাইক্রোচিপ থেকে শুরু করে বিশাল ভবন, সেতু, অস্ত্রের কাঠামো, বুলেটপ্রুফ পোশাক—এ জাতীয় মিশ্র বস্তু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফাইবার দিয়ে করা হচ্ছে। এদিকে আমাদের দেশেই যে পরিমাণ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন, তার অধিকাংশই জোগান দিতে পারছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
কেন পড়বো?
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন পেশাজীবী হিসেবে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন মাসকো গ্রুপের সিনিয়র মারচেন্ডাইজার মাহফুজ আহমেদ। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি করার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগেই। কিন্তু কোন বিষয়ে পড়বো, তা নির্বাচন করার জন্য ক্যারিয়ারের সুযোগগুলো হিসেব করে তিনটি প্রধান কারণে প্রভাবিত হয়েছি।
প্রথমত, চাকরির বাজারে এ বিষয়ে বিচিত্র প্রকৃতির কাজের ক্ষেত্র আছে। পড়াশোনা শেষ করার পর যে ধরনের কাজে আগ্রহ পাবো; সেদিকে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
দ্বিতীয়ত, এ সেক্টরে ক্যারিয়ারের গ্রোথ ভালো। অর্থাৎ একজন ফ্রেশার যেমন বেতনেই শুরু করুক; ভালো মানের যে কোনো প্রতিষ্ঠানে দ্রুত বেতন বাড়ে। একই সঙ্গে অভিজ্ঞতাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তৃতীয়ত, জীবনের যে কোনো পর্যায়ে কেউ যদি নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে চান। অর্থাৎ উদ্যোক্তা হতে চান, এ বিষয়ের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তুলনামূলক সহজেই ব্যবসার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
ক্যারিয়ার কোথায়?
এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশে থাকার পরও কর্মক্ষেত্রে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটের সংকট আছে। টেক্সটাইল মিল, কারখানা, বায়িং হাউজ, মানবসম্পদ, ফ্যাশন ডিজাইনিং, বিপণন সবখানেই টেক্সটাইল প্রকৌশলীদের জন্য দরজা খোলা আছে। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে শুধু যে টেক্সটাইল মিল, কারখানায় কাজ করতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন কিংবা মেশিন ডিজাইন, মেশিন রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে পড়ছেন; তারা টেক্সটাইলের বাইরে অন্য কাজের ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারেন। কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চান, তার জন্যও আছে অপার সুযোগ।
দেশে টেক্সটাইল যন্ত্রের নকশার ক্ষেত্রটি এখনো চর্চায় আসা বাকি। যন্ত্রের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প। অন্যদিকে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকও বিদেশি। এখনকার তরুণ উদ্যোক্তারা এ খাতগুলো নিয়ে ভাবতে পারেন।
ইদানীং অনেকেই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছেন। কেউ স্নাতকোত্তর, পিএইচডি করে দেশে ফিরে এসে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। কেউবা সেই দেশেই চাকরি খুঁজে নিচ্ছেন। বিসিএসও দিচ্ছেন অনেকে।
- আরও পড়ুন
- বায়োটেক পোশাকশিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম
- কেন পড়বেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি
- কেন পড়বেন সাংবাদিকতা
কোথায় পড়বো?
১. টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশে মোট পাঁচটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুটেক্স একমাত্র বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে মোট ১০টি বিষয়ের ওপর বিএসসি ও এমএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি দেওয়া হয়। তবে বুটেক্সে মোট আসন সংখ্যা মাত্র ৬০০।
২. ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
৪. যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
৫. মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েট প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপরও পড়াশোনা করার সুযোগ আছে।
সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৯টি সরকারি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে। যেগুলো চার বছর মেয়াদি বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিয়ে থাকে:
১. বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টাঙ্গাইল।
২. চট্টগ্রাম টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৩. পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৪. বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, নোয়াখালী।
৫. বরিশাল শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৬. ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৭. ঝিনাইদহ শেখ কামাল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৮. বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, নরসিংদী।
৯. শেখ রেহেনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, গোপালগঞ্জ।
প্রতিটি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম বুটেক্সের সিলেবাস অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং পাসের সনদপত্রও দেয় বুটেক্স।
বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে টেক্সটাইল শিক্ষাবিষয়ক ইনস্টিটিউট হলো ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ। যা নিটার নামে পরিচিত। এর ভর্তিকার্যক্রম পরিচালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি গ্রহণের সুযোগ আছে। এসব ইনস্টিটিউটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো:
১. দিনাজপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট পুলহাট, দিনাজপুর।
২. টাঙ্গাইল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, বাজিতপুর, টাঙ্গাইল।
৩. বরিশাল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, গৌরনদী, বরিশাল।
৪. নাটোর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, নাটোর।
৫. রংপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, রংপুর।
৬. চট্টগ্রাম টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, লবণচরা।
এ ছাড়া বেসরকারি টেক্সটাইল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো:
১. আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স টেকনোলজি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য বিখ্যাত। বিএসসি চালু করা বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এটি।
২. বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি
৩. ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
৪. শান্তা-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি
৫. বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি
৬. সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি
৭. নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
৮. সিটি ইউনিভার্সিটি
৯. সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়
১০. প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি
১১. গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
১২. অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
চাকরির সুযোগ
একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে ও পদে কাজ করতে পারেন:
১. বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি
২. কেমিক্যাল, ফ্যাব্রিক, ইয়ার্ন মার্কেটিং
৩. মেশিন মাকেটিং
৪. দেশি-বিদেশি কনসাল্টেন্সি
৫. ড্যাটা অ্যানালাইসিস
৬. শিক্ষকতা
৭. আইএফসির মতো বিভিন্ন ডেভেলপমেন্ট সংস্থা
৮. আরএমজি
৯. ফ্যাশন ডিজাইনিং
১০. জুট ও অ্যাগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট
১১. সরকারি প্রতিষ্ঠান
১২. ডেনিম সেক্টর
১৩. গার্মেন্ট ওয়াশিং
১৪. গার্মেন্টস কোম্পানি
১৫. দেশি-বিদেশি বায়িং হাউজ
১৬. শিল্প ঋণ প্রদানকারী সংস্থা
১৭. ট্রেডিং হাউজ
১৮. বিভিন্ন স্পিনিং, নিটিং, উইভিং এবং ডাইং মিল
১৯. প্রিন্টিং
২০. আবার ব্যাংকের প্রজেক্ট ফাইন্যান্সেও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা
টিউশন ফি ছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে টেক্সটাইলে বিএসসি, এমএসসি এবং পিএইচডি করার সুযোগ আছে। এজন্য আইইএলটিএস স্কোর সর্বনিম্ন ৬.৫ বা তার বেশি প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া জিআরই, টোফেল কোর্সে ভালো স্কোর থাকলে ফুল ফ্রি স্কলারশিপ পাওয়া সম্ভব। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, জার্মানি সবচেয়ে উপযোগী। কারণ এখানে টিউশন ফি লাগে না। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে ১০ থেকে ৫০% পর্যন্ত স্কলারশিপ দিয়ে থাকে।
- আরও পড়ুন
- বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয় নির্ধারণ করবেন কীভাবে
- কৃষিবিজ্ঞানে অনার্স, চাকরি কোথায়
- কী আশায় পড়বো আইন?
এএমপি/এসইউ/জিকেএস