সপ্তাহজুড়ে কঠোর পরিশ্রমের পর সপ্তাহান্তটি ব্রিটিশদের বেশ আয়েশেই কাটানোর কথা। কিন্তু আজ আর বিছানায় আয়েশ করার উপায় নেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই ছুটছে টেমসের তীরে। উদ্দেশ্য একটাই। আজ যে টেমসে নৌকা বাইচ হবে। কেউ কেউ প্রতিযোগী আবার কেউ কেউ শুধুই দর্শক।
শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টেমসের দুই তীরে লোক সমাগম হতে থাকে। হরেক রকমের নৌকা নিয়ে মিলহিলে আসতে থাকে প্রতিযোগীরা। একের পর এক নৌকা নদীতে ভাসাতে থাকে টেমসের ঘোলা জলে। মারো টান হেইও। না, তারা নেটিভ ইংরেজীতেই তারা এসব বলছিল।
বলছি লন্ডনের রিভার ম্যারাথন ‘দ্য গ্রেট রিভার রেস‘-এর কথা। এটি এক অসাধারণ নৌকা বাইচ উৎসব! পূর্বে মিলওয়াল থেকে যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ছাব্বিশ মাইল নদীপথ পার হয়ে, লন্ডন ব্রিজ, টাউয়ার ব্রিজের মতো লন্ডনের বিখ্যাত সেতুগুলি নীচ দিয়ে নৌকা এগিয়ে যাবে পশ্চিমে রিচমন্ড পর্যন্ত।
এই প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত। কেউ কেউ আসে প্রতি বছর নিজের রেকর্ড ভাঙতে আসে, কেউ কেউ আসে রঙ-বেরঙের পোশাক পরে দাতব্য সংস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে আসে, কেউ কেউ আসে নেহায়েত আনন্দের জন্য। প্রতিযোগী হোক বা দর্শক হোক —সবাই একসাথে উপভোগ করে একটি উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দঘন দিন।
প্রথমবারের মতো এটি শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। তখন মাত্র ৬১টি নৌকায় অংশ নিয়েছিল বিভিন্ন উৎসাহী দল। ছোট কিশোর স্কাউট থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ সমুদ্র নাবিক, সবাই মিলে একটি রঙিন দল গঠন করেছিল—রোয়িং ক্লাব, পাব, স্কুল, নৌকা সমিতি এবং সেনাবাহিনী থেকে। আজ, এই প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩০০টি দল অংশ নেয় এবং এ প্রতিযোগিতাটি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের অনেক দেশ থেকে প্রতিযোগীরা আসে।
এই রেসটি শুধুমাত্র ফিক্সড সিট নৌকার জন্য। এখানে অংশ নেয় নানাধরনের নৌকা, যেমন ঐতিহ্যবাহী থেমস ওয়াটারমেনস কাটার। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি নৌকায় একজন কক্স, একজন যাত্রী এবং তিন ফুট বাই দুই ফুট পতাকা থাকতে হবে। সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হ্যান্ডিক্যাপিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।
সব বয়সীদের নিয়েই এবারের বাইচ। আছে প্রাপ্তবয়স্ক, জুনিয়র এবং প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীরা। ছোটদের জন্য রয়েছে আলাদা বিভাগ—১৪ বছরের নিচে, ১৬ বছরের নিচে এবং ১৮ বছরের নিচে। ভেটেরানদের জন্য রয়েছে ভেটেরান ৪০ প্লাস ও ৬০ প্লাস। তবে একটি নিয়ম আছে: জুনিয়র দলের নৌকায় অবশ্যই একজন দায়িত্বশীল প্রাপ্তবয়স্ক থাকতে হবে, যিনি কক্স বা যাত্রী—যেভাবেই থাকুন না কেন। এন্ট্রি ফর্ম পূরণের আগে ঠিক করে নিতে হবে বয়সভিত্তিক শ্রেণিতে কারা নাম লেখাবেন, কেননা এটির ওপর এন্ট্রি ফি নির্ভর করে।
কেউ ইচ্ছে করলে মিশ্র দলেও অংশ নিতে পারে। তবে শর্ত হলো, অন্তত অর্ধেক রোয়ার হতে হবে নারী। তাহলেই তারা মিক্সড ক্লাস ট্রফি জেতার যোগ্য। যদি নারীদের সংখ্যা অর্ধেকের কম হয়, তবে দলটি গণ্য হবে পুরুষ দলের অংশ হিসেবে।
প্রতিযোগিতা চলাকালীন কক্স বা যাত্রী চাইলে দলের অন্য সদস্যের সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করতে পারে, তবে অবশ্যই শ্রেণি-লিঙ্গ ও বয়সের নিয়ম মেনে চলতে হবে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে মিলহিল এরিয়ার টেমস নৌকায় ভরে যায়। সবাই এলোপাথাড়ি ট্র্যায়াল দিতে থাকে। তালে তালে ছপ ছপ শব্দ করে নদীতে পড়ে দাঁড়ের বৈঠা।
বেলা সাড়ে দশটা বাজার সাথে সাথে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সবার গন্তব্যস্থল পশ্চিমের রিচমন্ড। আস্তে আস্তে নৌকা চলে প্রথমে। দূরত্ব কমার সাথে সাথে বাড়ে নৌকার বেগ। দেখতে দেখতে নৌকাগুলি দূর দিগন্তে টেমসের পানিতে একাকার হয়ে যায়। আমার পাশে দাঁড়ানো দুই ইংরেজ। বেশ মজা করছিল। একজন সাইকেল নিয়ে, আরেকজন সাইকেল বিহীন। সাইকেল বিহীন ইংরেজ ভদ্রলোক তার সাথীকে বললো, তুমি সাইকেলে আস, আর আমি যাই বাসে করে।
টাওয়ার ব্রিজের ওপর থেকে নৌকা বাইচ না দেখলে বাইচ দেখার মজাই থাকলো না। ভদ্রলোক দৌড় দেয়, সাইকেল ওয়ালা সাইকেলে প্যাডেল দেয়, আর আমি বাড়ির পথ ধরি।
এমআরএম/জিকেএস