টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম বল খেলা বিদ্যুৎ এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী

2 months ago 6

নারায়ণগঞ্জের ছেলে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের এক নম্বর ওপেনার হিসেবে খেলতে নামেন বন্ধুপ্রতিম মেহরাব হোসেন অপির সঙ্গে। ভারতীয় পেস বোলার জাভাগাল শ্রীনাথের করা প্রথম ওভারের প্রথম বলটি মোকাবিলা করেন বিদ্যুৎ। মানে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটার হলেন বিদ্যুৎ, যিনি প্রথম বলটি মোকাবিলা করেছিলেন।

৮৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫০ বলে ১২ রান করে ভারতের বাঁ-হাতি স্পিনার সুনিল জোসির বলে সৌরভ গাঙ্গুলির হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বিদ্যুৎ। দেশের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বাউন্ডারিটিও আসে বিদ্যুতের ব্যাট থেকে।

বর্তমানে যে অবস্থায় আছেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ

বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ। খেলা ছেড়ে প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জের অপর দুই ক্রিকেটার জাহাঙ্গীর আলম ও জাকারিয়া ইমতিয়াজের সাথে ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেও পরবর্তীতে ক্যাবল ও টেক্সটাইল শিল্পের সাথে জড়িত হন। এখন নারায়ণগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও সফল শিল্পপতি। সরাসরি ক্রিকেটীয় কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না থাকলেও নারায়ণগঞ্জে খেলোয়াড় কল্যাণ পরিষদ কোয়াবের সেক্রেটারি, নারায়ণগঞ্জ মাষ্টার্স ক্রিকেটের প্রেসিডেন্ট।

Biddut

ব্যক্তি জীবনে ৩ সন্তানের জনক বিদ্যুৎ। তারা কে কি করে? বিদ্যুৎ জানালেন, ‘বড় মেয়ে কানডায় গ্র্যাজুয়েশন করলো। আর ছোট মেয়ে এবার এসএসসি দিলো। ছোট ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে।’

ঘরোয়া ক্রিকেটে বিদ্যুৎ

টেস্ট অভিষেকের সময়ও বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল ক্লাবকেন্দ্রিক। এখন তবু এনসিএল ও বিসিএলের গায়ে বড় আসরের তকমা লেগেছে। ম্যাচ ফি, আবাসন, আনুমাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা ও প্রাইজমানি- সবই বেড়েছে। তবে বিদ্যুতরা যখন টেস্ট খেলতে শুরু করেন, তখন জাতীয় লিগ ছিল দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের একমাত্র আসর। যার আকার, পরিধিও ছিল ছোট। এখনকার সুযোগ সুবিধার অনেকটাই ছিল না।

বাংলাদেশ যখন টেস্ট মর্যাদা পায় তার মাত্র দুই বছর আগে জাতীয় লিগ শুরু হয়েছিল। তখন ঢাকা লিগে বিদ্যুৎ খেলতেন গোপিবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের হয়ে। টেস্ট দলের এক নম্বর ওপেনার বিদ্যুতের একটি রেকর্ড তাকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে। তাহলো, বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ শহরের বিদ্যুৎ প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটার, যার আছে কোন ভিনদেশি দলের বিপক্ষে উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি। এমসিসির বিপক্ষে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরির কৃতিত্বের অধিকারী বিদ্যুৎ। সেটাও টেস্ট অভিষেকের আশপাশের সময়ে।

Biddut

ঢাকা লিগে চার চারবারের টপ স্কোরার বিদ্যুৎ এখনো ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যলারি ভরা দর্শকে খেলার স্মৃতি রোমন্থন করেন। ‘ইস! স্টেডিয়ামভরা দর্শক হতো তখন! কি যে উত্তেজনা, আকর্ষণ আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল!’’

এমসিসির বিপক্ষে উভয় ইনিংসে শতরানের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে বিদ্যুৎ বলে ওঠেন, ‘আমরা বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে মনে হয় এমসিসির সাথে মনে হয় এক ইনিংসে ১৫৩ আর ১২৯ রান করি।’

 

অভিষেক টেস্টের আগে স্মরণীয় ঘটনা

অভিষেক টেস্টের আগে কোনো স্মরণীয় ঘটনা মনে আছে কী? বিদ্যুতের জবাব, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আসলে তখন আমরা ওপেনার ছিলাম তিনজন। অপি (মেহেরাব হোসেন), জাভেদ (জাভেদ ওমর) আর আমি। তাদের কোন দু’জনকে খেলানো হবে, তা নিয়ে ছিল সংশয়। ভারতের সাথে আমাদের প্রথম টেস্টের আগে একাদশ সাজাতে গিয়ে আমাদের তখনকার কোচ ইমরান ভাই (সারোয়ার ইমরান) আমাদের বিকেএসপিতে একটি তিনদিনের প্র্যাকটিস ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন।

test team

আমি ওই প্র্যাকটিস ম্যাচে সেঞ্চুরি করে বসলাম। বলতে পারেন, ওই সেঞ্চুরির পরই আমার একাদশে থাকা এবং ওপেন করা এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে যায়। হান্ড্রেডের পর আমি কনফার্ম হয়ে যাই। পরদিন পত্রিকায় নিউজ চলে আসে, প্র্যাকটিস ম্যাচে শতরান করে একাদশে জায়গা নিশ্চিত বিদ্যুতের।

অভিষেক টেস্টের স্মৃতি

অভিষেক টেস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেভাবে কিছু মনে করতে পারেননি প্রথমে। পরে স্মৃতি হাতড়ে বিদ্যুৎ বলে উঠলেন, খেলার স্মৃতি সেভাবে মনে নেই। কারণ ২৫ বছর দীর্ঘ সময়। সেভাবে টেস্ট চলাকালীন সময়ের কোন স্মৃতি মনেও আসছে না।

অভিষেক টেস্টের স্মৃতি বলতে গিয়ে একটি কথাই বলবো, ‘ভারত তখন অনেক বড় দল। টেস্টের প্রতিষ্ঠিত শক্তি। ভারতের হয়ে বোলিং শুরু করেছিলেন সে সময়ের দুই প্রতিষ্ঠিত পেস বোলার জাভাগাল শ্রীনাথ ও জহির খান। তবে আমরা ভীত ছিলাম না। ভয় পাইনি। যদিও এক্সাইটেড ছিলাম। ভারতের সাথে টেস্ট খেলবো, সেটাই ছিল মনে। আমাদের ছিল যাত্রা শুরুর নতুন উৎসব; আনন্দ। সেখানে আবেগ ছিল। বলতে পারেন, ফ্যাস্টিভ মুডে টেস্ট খেলা শুরু করেছিলাম আমরা। তাই ভয়-ডরের কথা মাথায় আসেনি।’

Srinath

প্রথম বল মোকাবেলা করা এবং বাউন্ডারি মারার ঘটনা মনে আছে বিদ্যুতের। তিনি বলেন, ‘টেস্টের প্রথম বলটাও আমি মোকাবিলা করেছি। প্রথম বাউন্ডারিটাও আমি হাঁকিয়েছি। এটুকু মনে আছে শ্রীনাথকে প্রথম বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলাম আমি।’

অভিষেক টেস্ট খেলে নিজেকে বেশ গর্বিত ভাবছেন বিদ্যুৎ। তিনি বলেন, ‘অভিষেক টেস্টের ক্রিকেটার হিসেবে আমি গর্বিত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস যতদিন থাকবে আমাদের নামও থাকবে। টেস্ট স্কোয়াডে থাকা সবার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা হয়ত কেউই খুব বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলিনি। তবে দেশের হয়ে প্রথম টেস্ট খেলতে পেরেছিলাম। সেটা অনেক বড় অর্জন, প্রাপ্তি এবং গর্বের। মাথায় টেস্ট ক্যাপ যখন পরলাম, তখন মনে হলো অনেক কিছু পেয়ে গেছি। আমি টেস্ট প্লেয়ার হয়ে গেছি।’

বিসিবিতে যেতে চান বিদ্যুৎ

আজকে আমি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তবে তারও আগে আমি একজন টেস্ট প্লেয়ার এবং দেশের হয়ে প্রথম টেস্ট খেলেছি। এখন একটাই আশা, ‘আমি দেশের হয়ে টেস্ট খেলেছি। ৯৯‘তে প্রথম বিশ্বকাপও খেলেছি। দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে চাই। আজ আমি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তবে ক্রিকেট আমার প্রথম ভালবাসা। চেষ্টা করেছি নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে।’

আল শাহরিয়ার বিদ্যুৎ-এর কথা, ‘আমি ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চাই। নারায়ণগঞ্জের প্রতিনিধি হয়ে ক্রিকেট বোর্ডে আসতে চাই। আমি চাই ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে চাই। নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেটের অবস্থা ভয়াবহ। আমিসহ আরও ৩/৪ জন মিলে উদ্যোগ নিয়ে নারায়ণগঞ্জের খেলা চালিয়েছি। আমি নিজে ৭ বছর স্পন্সর হয়ে নারায়ণগঞ্জ লিগ চালিয়েছি। তবে আমার কাজ করতে হলে একটা প্লাটফর্ম দরকার। আমি সেটা চাই।’

biddut

নারায়ণগঞ্জ ক্রিকেট নিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই অগ্রজপ্রতিম এবং নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই সাবেক নামী ও প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার জাহাঙ্গীর আলম ও জাকারিয়া ইমতিয়াজের সাথে নারায়ণগঞ্জে ক্রিকেট একাডেমি করা দিয়ে শুরু করেছি। তারপর মাস্টার্স ক্রিকেটের অন্যতম আয়োজক আমি। ক্রিকেটারদের কল্যাণ ও স্বার্থ সংরক্ষণের কথা ভেবে কোয়াব নারায়ণগঞ্জের সেক্রেটারিও হয়েছি।’

‘নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে খেলেই আমি ক্রিকেটার হয়েছি। বিশ্বকাপ খেলেছি। টেস্ট খেলেছি। তাই নারায়ণগঞ্জের ক্রিকেটের প্রতি আমার রয়েছে একটা বড় দায়বদ্ধতা; কিন্তু আমার আশা নারায়ণগঞ্জের গন্ডি পেরিয়ে আমি দেশের ক্রিকেটের জন্য কিছু করবো। আমি ক্রিকেট বোর্ডে যেতে চাই। দেশের ক্রিকেটের জন্য কাজ করতে গেলে একটা প্লাটফর্ম লাগে। আমি সেটা চাই। আগামীতে বিসিবিতে থাকতে চাই।’

সংবর্ধনা নিয়ে অনুভূতি

২৬ জুন টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তির রজতজয়ন্তীতে বিসিবি অভিষেক টেস্ট স্কোয়াডের ১৬ ক্রিকেটার, কোচ ও ম্যানেজারকে সংবর্ধিত করবে। সম্মাননা জানাবে। এটা জেনে দারুন খুশি বিদ্যুৎ। রীতিমত অভিভুত।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সেই অভিষেক টেস্টের দলকে বিসিবি সংবর্ধনা দেবে। এটা জেনেই খুব ভাল লাগছে। গর্ব অনুভব করছি। বোর্ডের পক্ষ থেকে ক্রিকেট অপারেশন্স ম্যানেজার শাহরিয়ার নাফীস ফোন করে ওই প্রোগ্রামের কথা জানালো। আমাকে হোয়াটসআপে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে।’

Biddut

সংবর্ধনার কথা শুনে যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন বিদ্যুৎ। তিনি বলেন, ‘আমার দুই সহযোগী অপি আর জাভেদ বললো, বিদ্যুৎ মিরপুরে ‘ফেরদৌসে (টেইলার্স) গিয়ে ব্লেজারের মাপটা দিয়ে আয়। সঙ্গে ভেতরে একটা অন্যরকম ভাললাগার ঝিলিক খেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আগের স্মৃতি মনে হয়ে গেল। বারবার মনে হচ্ছে সবার সাথে দেখা হয়ে যাবে। কি যে মজা হবে!’

এআরবি/আইএইচএস

Read Entire Article