হাবিবুল বাশার সুমন নিজেকে খানিক দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। তার সমসাময়িক অনেকে বাংলাদেশের হয়ে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি আর ৯৯’র বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেললেও হাবিবুল বাশার সুমনের ওই দুই বড় ও ঐতিহাসিক আসরের কোনটাই খেলা হয়নি।
তা নিয়ে হাবিবুল বাশার সুমনের আক্ষেপ, অনুশোচনা কিন্তু কম নয়, অনেক। ‘আসলে আমি নিজেকে খানিক দুর্ভাগা ভাবি। এ কারণে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুটি বড় ও ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে আমি যুক্ত না। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি আর ১৯৯৯ সালের প্রথম বিশ্বকাপ- কোনোটাই খেলা হয়নি আমার। দুটিই দুঃখজনক’- আক্ষেপ নিয়েই বলছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন।
তখনও জাতীয় দলে অভিষেক হয়নি- এমন না। হাবিবুল বাশারের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে ১৯৯৫ সালে। ছিলেন নিয়মিত পারফরমারও। সেটা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অথচ আমি ১৯৯৬ সালেও জাতীয় দলে খেলেছি। ১৯৯৫ সালে শারজায় এশিয়া কাপে আমার আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে অভিষেক ঘটেছে। আমি কিন্তু ১৯৯৬ সালে এসিসি ট্রফিতেও ভাল খেলেছি। রান করেছি; কিন্তু আইসিসি ট্রফির দলে আমার জায়গা হয়নি।’
‘আবার তারপরের একবছর কিন্তু আমি দলে ছিলাম। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় আইসিসি ট্রফির আগে আমার নামের পাশে ৩টি ওয়ানডে খেলার তকমা বসে গেছে। আর ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের আগেও আমি ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ৭০ রানের (৮৫ বলে ৪ বাউন্ডারি ও ৩ ছক্কা) ভাল ইনিংস খেলেছি; কিন্তু ওসব বিবেচনায় আনা হয়নি। আমি ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাইনি। দুটিই মিস করেছি।’
বর্তমান প্রজন্মের হয়ত অনেকেরই জানা নেই যে, আইসিসি ট্রফি আর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে না পারার মত অভিষেক টেস্টটাও মিস করতে যাচ্ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন। শুরুতে প্রাথমিক দলে জায়গা হয়নি এ স্টাইলিশ ফ্রি-স্ট্রোক মেকারের।
আসুন জাগো নিউজের সাথে হাবিবুল বাশারের কথোপকোথনের এই অংশটা তার মুখ থেকেই শুনি! ‘আমিতো বাদ পড়ে যাই বিকেএসপিতে আবাসিক অনুশীলন পর্বের শেষেই। অভিষেক টেস্টের জন্য যে ১৪ জনের দল ঘোষণা করা হলো, প্রথমে সেই দলেও ছিলাম না। মনে আছে তখন আমরা পত্রিকা পড়ে জানতাম দলটা কেমন হলো, কে কে চান্স পেলো। যখন দল ঘোষণা করা হলো, তখন আমরা বিকেএসপিতে আবাসিক অনুশীলন ক্যাম্পে। দল ঘোষণার পর পত্রিকায় দেখলাম আমি নেই।’
‘অথচ অভিষেক টেস্টের ঠিক আগের ট্যুরে সাউথ আফ্রিকায়ও আমি দলে ছিলাম। মনে আছে বিকেএসপির অ্যাথলেটিক ট্র্যাকে বসে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। তখন ওই দিকটা খুব অন্ধকার থাকতো। হতাশ আর কেমন যেন হেল্পলেস লাগছিল। পরে আমার বউ গিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসলো। এরপর মিডিয়ায় অনেক রিয়্যাক্ট হলো। অনেক কড়া ভাষায় লেখা হলো, আমার ও মনি ভাইয়ের (এনামুল হক মনি) পক্ষে। পরে ১৪ থেকে বাড়িয়ে ১৬ জনের স্কোয়াড করা হলো। আমি আর মনি ভাই চান্স পেলাম।’
‘আমি কিন্তু বোর্ড থেকে খবর পাইনি যে আমাকে ডাকা হয়েছে। মনে আছে বুলবুল ভাই (বর্তমান বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম) ফোন করেছিল আমার বন্ধু ক্রিকেটার শোভনকে (মীর জিয়াউদ্দীন শোভন)। বুলবুল ভাই উদ্যোগ নিয়ে শোভনকে বলেছিলেন, আমাকে জানাতে। আমার এখনো মনে আছে, আমি তখন একটি ভাড়া বাসায় থাকি। ল্যান্ডফোন আর মোবাইল ছিল না। পরে শোভন তার ড্রাইভারকে দিয়ে আমার বাসায় খবর পাঠালেন যে, আমি চান্স পেয়েছি। সেটাও বিশ্বাস হচ্ছিল না।’
‘১৬ জনের দলে ঢোকার পর বিকেএসপিতেই একটা তিনদিনের প্রস্তুতি ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ম্যাচে আমি ৯০ প্লাস রান করেছিলাম। সেটা আমার একাদশে জায়গা পেতে সাহায্য করেছিল। তখনই মনে হচ্ছিল, আমি অভিষেক টেস্ট খেলতে যাচ্ছি। আসলে
টেস্ট খেলার স্বপ্ন, ইচ্ছে ছিল। এমন নয় প্রথম টেস্টটাই খেলতে চেয়েছি। টার্গেট ছিল একটা টেস্ট যেন খেলতে পারি।’
‘শুধু আমার কথা বলা কেন, আসলে টেস্ট খেলাটা ছিল পুরো জাতির স্বপ্ন, স্বাধ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আমার শহর কুষ্টিয়ায় রীতিমত বড়সড় মিছিল বের হইছিল যে আমি টেস্ট দলে জায়গা পেয়েছি। আমিও মিছিল করেছিলাম। আমি তখন ব্রাদার্সের হয়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট খেলি। স্ট্যাটাস পাওয়ার পরের বাকি সময়টুকু আমাদের সব কথার মধ্যেই থাকতো টেস্ট। টেস্ট নিয়েই আলাপ করতাম।’
বলে রাখা ভাল, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও মেহরাব হোসেন অপির পর ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে দেশের হয়ে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি (১৫৭ মিনিটে ১১২ বলে ১০ বাউন্ডারিতে ৭১) উপহার দেন হাবিবুল বাশার সুমন।
আপনি যে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান, সেটা নিয়ে কোন বিশেষ স্মৃতি? তা নিয়ে আপনার অনুভুতিটাই বা কি?
হাবিবুল বাশার সুমন বলেন, ‘আসলে সত্যি বলতে কি, তেমন কোন বিশেষ অনুভুতি নেই। কারণ ম্যাচে কেমনে কি খেলেছি, উইকেটে নেমে কি করেছি, কিচ্ছু মনে নেই। আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম। টেস্ট খেলছি। সেটাই ছিল মাথায়। আসলে টেস্ট কেমনে খেলতে হয়, জানতাম না। রান করতে কি কি ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করতে হয়, তাও জানা ছিল না। আসলে সুপার এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল। সুপার এক্সাইটেড ছিলাম।
ভেতরে একটা রোমাঞ্চকর অনুভতি কাজ করছিল। আমি উইকেটে গিয়ে আমার মত খেলেছি। আমি এনজয় করেছি। আমার প্ল্যান ছিল মারার বল মারবো, বাস্তবে আমি সেটাই করেছি।’
অভিষেক টেস্টের দলে আপনি ছিলেন। সেই দলকে বিশেষ সন্মাননা দেওয়া হচ্ছে। অনুভুতিটা কেমন? ‘অবশ্যই খুব ভাল। সত্যি বলতে কি, আমার জীবনে দুটি অর্জন বা প্রাপ্তি দারুনভাবে আলোড়িত করে। এক) অভিষেক টেস্ট আর প্রথম টেস্ট জয়। দুটি সাফল্যের মাইলফলকের সাথেই আমি ছিলাম। একটাতে আমি ছিলাম। আর অন্যটায় আমি অধিনায়ক ছিলাম। ওই দুটি মোমেন্ট আমার কাছে স্পেশাল। আমি যত টেস্ট খেলেছি ওই ২টাই অন্যরকম।’
ব্যক্তি জীবনে দুই সন্তানের জনক হাবিবুল বাশার। ‘আমার বড় ছেলে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছে; থার্ড ইয়ারে। আমার ছোট ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে।’
খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পর ক্রিকেটের সঙ্গেই আছেন হাবিবুল বাশার সুমন। আছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে। নিজেই জানালেন সে তথ্য, ‘ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছি। খেলা ছাড়ার পর থেকে বোর্ডের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে পড়ি। জাতীয় দলে সিলেক্টর হয়ে যাই। ওই পদে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। বর্তমানে ক্রিকেট বোর্ডে চাকুরিরত, হেড অফ অপারেশন্স গেম ডেভোলপমেন্ট।’
আরআই/আইএইচএস/