ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে কেমন হবে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি?
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় আবারও বিশ্বরাজনীতিতে আনতে যাচ্ছে নতুন মোড়। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রাজনীতিতে আসছে বড়সড় পরিবর্তনের আভাস।
বিশেষত দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা।
আলোচিত-সমালোচিত যাই বলি না কেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টরপন্থী আমেরিকা ফার্স্ট ব্যবসায়িক নীতি শুধুমাত্র মার্কিন মুল্লুকেই নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই বড়সড় ধাক্কা আনতে পারে। অবৈধ অধিবাসী প্রত্যাবাসন, মার্কিন নাগরিকদের বেকারত্ব হ্রাসকরণ, দেশীয় বাণিজ্যে বিনিয়োগ ও বিদেশি বাণিজ্যের ওপর শুল্ক প্রয়োগ এগুলোই ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট অর্থনৈতিক নীতি।
ইতঃপূর্বেও ট্রাম্পের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব দেখেছিলো বিশ্ব। এবার ধারণা করা যাচ্ছে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব আরো বাড়তে পারে, এবং চীনের বৈশ্বিক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ৬০% পর্যন্ত শুল্ক বাড়তে পারে যা চীনা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। চীনা অর্থনীতির গতি মন্থর হলে এর প্রভাব পড়বে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো সহ চীনা বিনিয়োগ নির্ভর নানা রাষ্ট্রে। বিশেষত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে ত্রিমুখী।
এক, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাময়িক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে, সকল চীনা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেখা দেয়ায় বাংলাদেশের সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসার সুযোগও রয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
দুই, ওয়াশিংটন যত এন্টি-চায়না রাজনৈতিক সীমারেখা টানবে, বাংলাদেশের জন্য ততই কঠিন হয়ে উঠবে দুই পরাশক্তির মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা। সেটা হোক অর্থনৈতিকভাবে কিংবা রাজনৈতিকভাবে। দুই পরাশক্তির দক্ষিণ এশীয় অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা সত্যিই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। বিশেষত চায়নার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করতে পারে, যা বাংলাদেশের মত দেশগুলোর জন্য ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
তিন, পরাশক্তিদের মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠলে বাংলাদেশকে হাঁটতে হবে কঠিন পথেই। আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সীমান্ত সুরক্ষা, গোয়েন্দা সংস্থার উন্নয়ন, উপকূলীয় জলসীমায় পণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আরো জোরদার নজর দিতে হবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির ধাক্কা লাগবে আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশিদের গায়েও। বিশেষত অবৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা প্রবাসীদের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সর্বোচ্চ কট্টর নীতি গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যেই ট্রাম্প জানিয়েছেন তার ইমিগ্রেশন পলিসিতে ১.৩৭৫ মিলিয়ন অবৈধ অধিবাসী আছে; যাদের কোনপ্রকার বৈধ কাগজপত্র নেই। এমন অবৈধ অধিবাসীদের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন কোন ছাড় দিবে না। তবে এই নীতি শুধুমাত্র বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যেই নয়, বরং সকল অবৈধ অধিবাসীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪৮ হাজার।
এদিকে, বাংলাদেশে গত জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে বেশকিছু নিষিদ্ধ সংগঠন সহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কার্যক্রম বেড়েছে। বাংলাদেশে আইএস, হিযবুত তাহরীর সহ বেশ কয়েকটি গ্লোবাল টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের পতাকা প্রকাশ্যে এসেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি স্বভাবতই জো বাইডেন কিংবা গড়পড়তা কোন প্রেসিডেন্টের মতো হবে না। যেহেতু ট্রাম্প নিজে একজন ব্যবসায়ী, আমি মনে করি তিনি বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াবেন না। অন্তত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে না তো বটেই। সেক্ষেত্রে, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পাশাপাশি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকেও সংকটপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে।
বিশেষত, স্থিতিশীল রাষ্ট্র না হওয়া অবদি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশে সীমিত পরিমাণে বিনিয়োগ করবে তা বলাই বাহুল্য। আর এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাবে ভারত, অন্যদিকে এন্টি-চায়না নীতি হিসেবে ভারত ট্রাম্পের জন্য একটি ভালো বিকল্পও।
তবে, বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে এমন রাজনৈতিক সমীকরণে। বাংলাদেশের ওপর থেকে ওয়াশিংটনের নজর কমে আসলে বাংলাদেশ চায়নার সাথে আগের চেয়েও ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, যা কি না বিগত ১৫ বছরে ভারত-পন্থী সরকারের কারণে সম্ভব হয়নি।
এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সর্বপ্রথম উচিত হবে অর্থনৈতিক ভিত্তিগুলোকে আপাতত স্থিতিশীল করা ও পরবর্তীতে আরো মজবুত করা। যেমন জুলাই অভ্যুত্থানের পর বেশকিছু গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে সম্পূর্ণ গার্মেন্টস সেক্টরেই। সেক্ষেত্রে সর্বপ্রথম স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে, ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অটোমেশন সিস্টেম তৈরি করে আরএমজি সেক্টরে আরো উন্নতি করা সম্ভব। গার্মেন্টস সেক্টর ছাড়াও, ফার্মাসিউটিক্যালস, শিপ ব্রেকিং, কৃষিজ পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর সবচেয়ে নাজুক সময় পার করছে, যেখানে প্রশাসন থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রতিরক্ষা বাহিনী এমনকি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও পরিবর্তন করা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শুধু তিন বাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং গোয়েন্দা সংস্থা, সীমান্ত সুরক্ষা, উপকূলীয় জলসীমা নিয়ন্ত্রণ করা, মাদক, সন্ত্রাসবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ সহ দেশের যে কোন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি নির্মূল করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। একই সাথে বহুপাক্ষিক কূটনীতি, বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথ সামরিক ও নৌ-মহড়া ও বঙ্গোপসাগরে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কড়াকড়িতে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ছায়ায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। বিশেষত চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব ও চীনের প্রক্সি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ওপর ওয়াশিংটনের নজর কিছুটা কমই পড়বে। এতে বাংলাদেশ সরাসরি বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে পারে। এবং, সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থেকে চীনের মাধ্যমে মায়ানমারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। কেননা ট্রাম্পের অর্থনীতিকেন্দ্রিক রাজনীতির ফলে, পাওয়ার ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হবে এ অঞ্চলে।
ঢাকা-বেইজিং শক্তিশালী সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে মায়ানমারকে স্থিতিশীল করা, আরাকানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু সবকিছুই বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হওয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যু ও মায়ানমারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার মত পদক্ষেপ নিতে সরকারের অভ্যন্তরীণ চাপ মোকাবেলা করা সহজ হবে।
মুহাম্মদ ইরফান সাদিক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়