মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়াকড়ি বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিবাদ নয় বরং নীরব প্রত্যাখ্যানের ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা বাস্তবে বিপরীত ফলাফল দিয়েছে। এই ফাঁকে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলছে চীনসহ বেশ কিছু দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
এই উদ্যোগকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার নাম দিয়েছেন `ট্রাম্প রাউন্ড'। সাবেক উপদেষ্টা পিটার নাভারো তো ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত বলেও দাবি করেছিলেন। তাদের মতে, আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্যকে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন।
একসময় বিশ্বের মোট আমদানির ২০ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ শতাংশে। অনেক দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে সাময়িক চুক্তি করলেও নিজেদের জন্য বিকল্প পথও তৈরি করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার এক কর্মকর্তার মতে, প্রথমে কিছু ছাড় দিতে হয়, তারপর বিকল্প খুঁজতে হয়।
বিশ্বজুড়ে নতুন কৌশল
ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ ভিন্নধর্মী পদক্ষেপ নিচ্ছে- যেমন ব্রাজিল ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে ট্যাক্স ছাড় ও সরকারি ক্রয় গ্যারান্টি রয়েছে। কানাডা ১ বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে কাঠশিল্পে সহায়তার জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকা রপ্তানিকারকদের জন্য শিপিং খরচ ভাগাভাগির সুযোগ তৈরি করছে, যা কিছু ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা আইনের সীমা অতিক্রম করছে। একইসাথে কানাডা ও জাপান ধাতু আমদানির ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেছে। ভারত তার মেড ইন ইন্ডিয়া নীতিকে সামনে এনে আত্মনির্ভরতার ডাক দিয়েছে। গত ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, স্থানীয়দের পক্ষে আমরা যত বেশি আওয়াজ তুলবো, তত দ্রুতই সমৃদ্ধি আসবে।
বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ এখন আমেরিকার বিকল্প বাজার খুঁজে নিচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকা চীনে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়িয়েছে। লেসোথো তাদের পোশাক শিল্প আমেরিকার বদলে এশিয়া ও আফ্রিকায় রপ্তানি করছে। ব্রাজিল ৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্কের পর কফি রপ্তানি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় সরিয়ে নিচ্ছে। তবে আমেরিকাকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া সহজ নয়। এখনও ব্রাজিলের কফির ১৬ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
গড়ে উঠছে নতুন জোট
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে আন্তর্জাতিক জোটে। কানাডা ও মেক্সিকো এখন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে, কারণ ট্রাম্পের সময়ে আমেরিকার নির্ভরযোগ্যতা কমতে শুরু করেছে। আগামী মাসে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি মেক্সিকো সফর করবেন, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জ্বালানি এবং বন্দর বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা হবে।
ব্রিকস জোট (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) এখন নিজেদের মধ্যে আগের চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্য করছে। ট্রাম্প ব্রাজিল ও ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসিয়েছেন। এর জবাবে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এখন ব্রিকস দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে আমেরিকার চেয়ে বেশি বাণিজ্য করছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামসহ এক ডজনের বেশি দেশ এই জোটে যোগ দিতে চেয়েছে।
লাভবান হচ্ছে চীন
চীন এখন আমেরিকার বদলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি বাড়িয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে চীনের এই অঞ্চলগুলোতে রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। জুলাই মাসে আমেরিকায় রপ্তানি কমলেও চীনের মোট রপ্তানি ৭ শতাংশ বেড়েছে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা করেছেন, আফ্রিকার ওপর সব আমদানি শুল্ক বাতিল করা হবে। তিনি এরই মধ্যেই ল্যাটিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
চলতি বছরের মধ্যে নতুন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই করতে যাচ্ছে চীন ও আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট)। এমনকি ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে। ইলেকট্রিক গাড়ি ও ব্যাটারি প্রযুক্তিতে চীন-ভারত যৌথ প্রকল্প শুরু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর আগামী সপ্তাহে চীন সফরের পরিকল্পনা রয়েছে — গত সাত বছরে এটাই হবে তার প্রথম সফর।
টিটিএন