‘অ্যাকাডেমিক জ্ঞানের সঙ্গে মানসিক শিক্ষার সমন্বয়েই বদলে যায় মানুষ ও সমাজ’ শিক্ষা এমন এক শক্তি, যা পৃথিবীতে ইতিবাচক পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সূচনা হতে হবে নিজের ভেতর থেকে।
আমরা যদি নিজেকে বদলাতে না পারি, তবে যতই শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করি না কেন, তা কেবল মুখের বুলি হয়েই থেকে যাবে—যেমন কথায় আছে, ‘থোড় বড়ি কলা, কলা বড়ি থোড়’। প্রকৃত শিক্ষা সেই, যা আমাদের চরিত্র, আচরণ ও চিন্তাধারায় দৃশ্যমান পরিবর্তন আনে, আর সেই পরিবর্তন থেকেই গড়ে ওঠে একটি উন্নত বিশ্ব।
‘প্রকৃত শিক্ষা সেই, যা মানুষের ভেতরে আলো জ্বালায়।’
শিক্ষা ও মহান চিন্তাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
শিক্ষাবিদ কমেনিয়াস বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতির সাহায্যে ইহলোক ও পরলোকের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ নিজেকে ও বিশ্বকে জানতে পারে।’
ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে মানুষের বহুমুখী প্রতিভা ও অনুরাগের সুষম প্রকাশ এবং নৈতিক চরিত্র গঠন।’
দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার।’
সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি
শিক্ষাবিদ হাওয়ার্ড গার্ডনার, যিনি বহুমাত্রিক বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন বলেছেন, শিক্ষা কেবল তথ্য শেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছাত্রদের নিজেদের শক্তি, অনুরাগ এবং সৃজনশীলতা আবিষ্কার করার সুযোগ দেয়।’
এই দৃষ্টিভঙ্গি স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিক্ষার প্রকৃত মান শুধুই অ্যাকাডেমিক অর্জনে নয় বরং আত্ম-উন্নয়ন, চিন্তাভাবনা সম্প্রসারণ এবং ব্যক্তিগত দক্ষতার বিকাশে নিহিত। সমকালীন এই দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যবাহী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদদের মতবাদকে সমৃদ্ধ করে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে।
সত্য সন্ধান ও আত্ম-উপলব্ধি
প্রকৃত শিক্ষা কেবল বইপত্রের জ্ঞান নয়; এটি সঠিক আত্ম-উপলব্ধির পথও। ধরা যাক, ছোটবেলা থেকে আপনি কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা শুনে বড় হলেন। বড় বয়সেও সেই বিশ্বাস আঁকড়ে আছেন। কিন্তু চারপাশে সমালোচনার ঢেউ উঠছে। প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি এ অবস্থায় নিরপেক্ষ উৎস থেকে যাচাই করবেন, যা এতদিন শুনে এসেছেন তা সত্য নাকি সুবিধাবাদী শ্রেণীর সাজানো গল্প।
অ্যাকাডেমির ও মানসিক শিক্ষার সমন্বয়
শুধু বই পড়ে ডিগ্রি অর্জন করলেই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হওয়া যায় না। অ্যাকাডেমিক শিক্ষা আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, কিন্তু মানসিক শিক্ষা—যেখানে বিবেকের জাগরণ, আত্ম-উপলব্ধি এবং চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটে—তাই আমাদের ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতা দেয়।
সময়ের সঙ্গে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে আপডেট করা, ভুল স্বীকার করে সংশোধন করা এবং অন্যের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তোলা—এসবই মানসিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুই ধরনের শিক্ষার সমন্বয়ই মানুষকে তথ্যসমৃদ্ধের পাশাপাশি জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও মানবিক করে তোলে।
‘ডিগ্রি নয়, বিবেকই প্রকৃত শিক্ষার প্রমাণ।’
শিক্ষাই পরিবর্তনের চাবিকাঠি
ব্যক্তিগত উন্নয়ন: শিক্ষা আত্ম-সচেতনতা বাড়ায় এবং আত্ম-উন্নতির পথে চালিত করে।
সামাজিক পরিবর্তন: ব্যক্তিগত পরিবর্তন সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, সৃষ্টি হয় ন্যায়পরায়ণ ও প্রগতিশীল পরিবেশ।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নতুন দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধ: সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝা ও ইতিবাচক আচরণ গড়ে ওঠে।
সুতরাং শিক্ষা কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়; এটি আত্ম-উন্নয়ন, সত্য সন্ধান এবং সামাজিক পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার। পরিবর্তনের প্রথম ধাপ নিজের ভেতরে শুরু হয়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যখন নিজেকে বদলায়, তখন সেই পরিবর্তন সমাজে, সমাজ থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাই শিক্ষা শুধু জীবনের অংশ নয়—এটি জীবনকে আলোকিত করার প্রধানতম উপায়।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
এমআরএম/জিকেএস