ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’

2 months ago 7

ঢাকা নগরীর ঘটনাবহুল ইতিহাস ও শিল্পসামগ্রীর পরিচয়কে বিভিন্ন বস্তুগত নিদর্শনের মাধ্যমে জনসম্মুখে তুলে ধরতে এবং নাগরিকদের মধ্যে ঐতিহ্য চেতনা সৃষ্টি করতে যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা নগর জাদুঘর। কিন্তু প্রচারণার অভাবে এবং অব্যবস্থাপনার কারণে জাদুঘরটিতে যান না দর্শনার্থীরা। অথচ ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানান নিদর্শন রয়েছে এই জাদুঘরে।

ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই জাদুঘরটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের ছয়তলায় বড় একটি হলরুমে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালের ২০ জুন প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘরে প্রবেশ মূল্য মাত্র ২ টাকা। কিন্তু তারপরও জাদুঘরটিতে দর্শনার্থীদের আনাগোনা নেই। দিনে গড়ে ৮-১০ জন দর্শনার্থী সেখানে যান। যাদের অধিকাংশই কৌতূহল নিয়ে জাদুঘরটি দেখতে যান।

জাদুঘরটি পরিচালনা করে ডিএসসিসির সমাজ কল্যাণ বিভাগ। এ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা নগর জাদুঘরে পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক নির্দশন রয়েছে। সাধারণত বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি নিয়ে যারা পড়াশোনা বা গবেষণা করেন, তারা জাদুঘরটি দেখতে যান। এর বাইরে অধিকাংশ দর্শনার্থীই নগর ভবনে কাজে গিয়ে কৌতূহলে জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন।

ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’

বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ঢাকা নগরীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক বস্তু এবং বিষয়াদি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালের ২০ জুন ব্যক্তি মালিকানায় ঢাকা নগর জাদুঘরের আবির্ভাব ঘটে। এর প্রধান উদ্যোক্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। পুরান ঢাকার পাঁচ ভাই লেনের একটি প্রাচীন বাড়ি ছিল ঢাকা নগর জাদুঘরের প্রথম ঠিকানা। পরে জাদুঘরটি অধিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে সিটি করপোরেশন। ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই জাদুঘরটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়।

শুক্র ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকা নগর জাদুঘর খোলা। প্রবেশমূল্য ২ টাকা। তবে জাদুঘরে দৈনিক দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ কম।

ডিএসসিসির নগর ভবন পুরান ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত। বিশাল আয়তনের এ ভবনটি ১৪ তলা বিশিষ্ট। এর ষষ্ঠ তলায় রয়েছে একটি মসজিদ ও ক্যান্টিন। এর মাঝে বড় একটি হলরুমে রয়েছে ঢাকা নগর জাদুঘর। কিন্তু এখানে যে একটি জাদুঘর রয়েছে, তা করপোরেশনের ফটক, লিফট বা সিঁড়ি কোথাও কোনো সাইনবোর্ড বা ব্যানার দেখা যায়নি। ফলে করপোরেশনের ভেতর নগর জাদুঘর থাকার বিষয়টি সবারই অজানা থেকে যায়।

গত ২৫ জুন বিকেল ৩টায় নগর ভবনের লিফটের ৫-এ নেমেই পূর্ব পাশে ছোট একটি নামফলক চোখে পড়ে। এ ফলকে লেখা ঢাকা নগর জাদুঘর। ভেতরে গিয়ে প্রথমেই দেখা যাবে ১৯১২-১৯১৫ সালের ঢাকার মানচিত্র। যার পূর্বে হাটখোলা, পশ্চিমে হাজারীবাগ, উত্তরে রমনা আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। এটিই মোটাদাগে রাজধানীর সীমানা। পুরোনো মানচিত্রটির পাশেই রাখা আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এখনকার মানচিত্র। শুধু দক্ষিণ অংশের আয়তনই এখন সে সময়কার পুরো ঢাকার তিনগুণের বেশি। মানচিত্রটি ছাড়া এই জাদুঘরে আছে প্রাক্‌-মোগল আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত ঢাকার সীমানার ধারাবাহিক বৃদ্ধির নকশা।

ঢাকার মানুষের ঈদ উদযাপন বা রীতিনীতিরও বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মও রয়েছে জাদুঘরে। এসব চিত্রকর্ম আঠারো শতকের শেষ দিকে অথবা উনিশ শতকের শুরুর দিকের। ঢাকায় টিকে যাওয়া প্রাচীন চিত্রকর্মের অন্যতম নিদর্শন এগুলো। ঢাকার ইতিহাস সংবলিত ১০১টি দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে এই নগর জাদুঘরে।

ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’

দুর্লভ আলোকচিত্রের মধ্যে আছে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন, রূপলাল হাউজ, হোসেনী দালানের আদি রূপ, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, সাতগম্বুজ মসজিদ, উনিশ শতকে নির্মিত বিভিন্ন বাড়ি, সেন্ট জেমস গির্জা (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে), পুরোনো হাইকোর্ট ভবন, ১৯০৪ সালে দিলকুশার নবাববাড়ি। দেখা মিলবে ২০ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার নারীদের ব্যবহৃত তারজালির ভ্যানিটি ব্যাগ, কোমরের বিছা, হাঁসুলিসহ নানান সামগ্রীর।

ঢাকায় প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’র মুদ্রণ যন্ত্রটির দেখা মিলবে এই জাদুঘরে। এটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের এবং স্থাপন করেন সুইজারল্যান্ডের স্যামুয়েল বোস্ট। পুরান ঢাকার একটি জরাজীর্ণ বাড়ি থেকে ১৯৮৯ সালে ঢাকা নগর জাদুঘরের ট্রাস্টি হাশেম শফি সংরক্ষণ করেন মুদ্রণ যন্ত্রটির।

‘জাদুঘর এমন জায়গায় হওয়া উচিত, যেটা সবার চোখে পড়বে। অর্থাৎ দৃশ্যমান জায়গায় জাদুঘর থাকবে। তা হলে দর্শনার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। কিন্তু নগর জাদুঘর যে জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে, তা করপোরেশনে সেবাগ্রহীতারা জানেন না। ফলে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম।’- ডিএসসিসির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান

মোগল ও ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল, ছবি ও গ্রন্থসহ আরও অনেক মূল্যবান উপকরণও আছে এতে। ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানান আন্দোলনের বেশকিছু দুর্লভ আলোকচিত্র ও পোস্টার দেখা যায় এই জাদুঘরে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর কার্ড, পোস্টার, পুস্তিকা এবং ঢাকার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশ করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর, আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন ও মুনতাসীর মামুনের ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান।

প্রদর্শনীকক্ষে মাঝামাঝি রাখা আছে একটি মুদ্রণযন্ত্র। লোহার এই মুদ্রণযন্ত্রের গায়ে খোদাই করা আছে এর নাম, ‘ইমপ্রুভড আলবিওন প্রেস’। ক্যাপশন থেকে জানা গেলো, ১৮২২ সালের এই যন্ত্রটি ঢাকার প্রথমদিককার মুদ্রণযন্ত্রগুলোর একটি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এটি জাদুঘরে দান করেন।

ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’

একটি কাচের শোকেসে প্রায় ২ ফুট দৈর্ঘ্যের চামড়ার মশক রাখা আছে। ষাটের দশকের আগে এসব মশকে করেই হোটেল ও বসতবাড়িতে পানি সরবরাহ করা হতো। যারা বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতেন তাদের বলা হতো ভিস্তিওয়ালা। ষাটের দশকের এক ভিস্তিওয়ালার সাদা-কালো আলোকচিত্রও এখানে আছে। কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের এমন নির্দশন দেখতে কোনো দর্শনার্থীকে দেখা যায়নি।

নগর জাদুঘরের প্রবেশমুখেই রিসিপশন ডেক্স। এখানে রেজিস্ট্রি খাতা নিয়ে বসে আছেন রিসিপশনিস্ট মিন্নী আক্তার পুস্প। তিনি জানান, শুক্র ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় সকাল ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা। প্রবেশমূল্য ২ টাকা। তবে জাদুঘরে দৈনিক দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ কম। (২৫ জুন) সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র দুজন দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এর আগের দিন চারজন পরিদর্শন করেন।

‘এখানে একটি জাদুঘর আছে, তা চোখেই পড়ে না। সিটি করপোরেশন থেকে কোনো প্রচারণা নেই। নগর ভবনের কোথাও কোনো বোর্ড বা নির্দেশনা নেই। অথচ নাগরিক সেবা নিতে দিনে হাজারো মানুষ ডিএসসিসি প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে যান।’- দর্শনার্থী আল মামুন

নগর ভবনের ছয়তলার ক্যান্টিন থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন পরীবাগের বাসিন্দা আল মামুন। তিনি ট্রেড লাইসেন্স করতে নগর ভবনে গিয়েছিলেন।

আলাপকালে মামুন বলেন, ‘এখানে একটি জাদুঘর আছে, তা চোখেই পড়ে না। সিটি করপোরেশন থেকে কোনো প্রচারণা নেই। নগর ভবনের কোথাও কোনো বোর্ড বা নির্দেশনা নেই। অথচ নাগরিক সেবা নিতে দিনে হাজারো মানুষ ডিএসসিসি প্রধান কার্যালয় নগর ভবনে যান।’

ঢাকার নগর জাদুঘর দেখতে যায় না ‘কেউ’

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাদুঘর এমন জায়গায় হওয়া উচিত, যেটা সবার চোখে পড়বে। অর্থাৎ দৃশ্যমান জায়গায় জাদুঘর থাকবে। তা হলে দর্শনার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। কিন্তু নগর জাদুঘর যে জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে, তা করপোরেশনে সেবাগ্রহীতারা জানেন না। ফলে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম।’

মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘নগর জাদুঘরের উপযুক্ত স্থান নগর ভবনের নিচতলায়। কিন্তু এখানে কয়েকটি ব্যাংককে জায়গা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ স্থানে জাদুঘর স্থানান্তর করা গেলে সবচেয়ে ভালো হবে। নগর ভবনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।’

এমএমএ/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম

Read Entire Article