ঢাবির এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা

6 hours ago 4

*মাঠে সামান্য বৃষ্টিতে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা
*বহিরাগতরা অবাধে অনুপ্রবেশ করেন
*মানিব্যাগ, ফোন, খেলার সামগ্রী চুরি হয়
*জিমনেসিয়ামে সরঞ্জাম অপ্রতুল ও পুরোনো
*দ্রুত মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুর তাগিদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ যেন পরিণত হয়েছে ধানক্ষেতে। নেই প্রয়োজনীয় ঘাস। সামান্য বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়াসহ নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া মাঠে বহিরাগতদের অবাধ অনুপ্রবেশ এবং খেলোয়াড়দের বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি হওয়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।

ঢাবির এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা
নিচু দেওয়াল টপকে সহজে মাঠে প্রবেশ করতে পারেন বহিরাগতরা/ছবি: জাগো নিউজ

তাদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) নতুন নেতৃত্ব এলেও সেখানকার পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি।

নিরাপত্তার এত বাজে অবস্থা, তা বলে বোঝানো অসম্ভব। আমার বন্ধুর সাইকেল চুরি হয়েছে, সিসি ক্যামেরায় দেখাও গেছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেই সাইকেল তো আর ফিরে পাওয়া যায়নি। মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি হওয়া তো নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।- রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহাদুর রহমান

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মাফিজুল হাসান তুহিন বলেন, ‘কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। ঘাসের পরিমাণ কম। ফলে খেলার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। বৃষ্টিতে মাঠের অবস্থা আরও খারাপ হয়। আন্তবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের কিছু ম্যাচ সেই অবস্থায়ই হয়েছে।’

মাঠের অবস্থাকে অত্যন্ত ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মুনতাসির নাসিফ। তিনি জানান, অল্প বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। মাঠ তখন যেন ধানক্ষেত হয়ে যায়।

একই কথা শোনা যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহাদুর রহমানের মুখেও। তিনি বলেন, ১০-১৫ মিনিট বৃষ্টি হলেই মাঠ হয়ে যায় পুকুর।

ঢাবির এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা
মাঠ পরিচর্যার রোলার পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়/ছবি: জাগো নিউজ

এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলা ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী সুষম জানান, কেন্দ্রীয় মাঠ এখন খানাখন্দে ভরপুর। তার পা একটি গর্তে পড়ে ভেঙেছে।

আরও পড়ুন
টানা তৃতীয়বারের মতো জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন ঢাবির নোশিন
শাবিপ্রবিতে নিরাপত্তাকর্মীকে লাথি, দুই বহিরাগতকে পুলিশে সোপর্দ
চট্টগ্রামের সব ওয়ার্ডে খেলার মাঠ-পার্ক হবে: মেয়র শাহাদাত

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সংসদ-২ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে মনিরুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়ের ছবি পোস্ট করে লেখেন, এটি ঢাবির কেন্দ্রীয় ধানক্ষেত মাঠের ফলাফল। তিনি এ মাঠের মান নিয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেন।

বহিরাগতদের অবাধ অনুপ্রবেশ
মাঠে বহিরাগতরা অনুপ্রবেশ করেন। ফলে নিয়মিতই চুরির ঘটনা ঘটছে। মাঠের চারপাশের দেওয়াল অরক্ষিত থাকা এবং কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব এই নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ।

শিক্ষার্থী মাফিজুল হাসান অভিযোগ করেন, নির্দিষ্ট কিছু বহিরাগত নিয়মিতই চুরি করে। শিক্ষার্থীদের মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন, খেলার সামগ্রী চুরি হয় বেশি।

আমি এক বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি, বিশেষ করে দেওয়াল উঁচু করে যেন বহিরাগত ঠেকানো যায়। কিন্তু টাকা নেই বলে আমার এই ফাইল ফেলে রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বন্ধের সময় আমি আমার টিম নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করি।- প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আহাদুর বলেন, ‘নিরাপত্তার এত বাজে অবস্থা, তা বলে বোঝানো অসম্ভব। আমার বন্ধুর সাইকেল চুরি হয়েছে, সিসি ক্যামেরায় দেখাও গেছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেই সাইকেল তো আর ফিরে পাওয়া যায়নি। মোবাইল-মানিব্যাগ চুরি হওয়া তো নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

অন্যদিকে শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম ফেসবুকে উল্লেখ করেন, প্রতি বছর খেলার মৌসুমে ফোন, মানিব্যাগ, সাইকেল হারানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

আরও পড়ুন
পাবিপ্রবি: ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে দুই বিভাগের হাতাহাতি, শিক্ষকসহ আহত ৮
ঢাবির হলে ধূমপানে জরিমানা, মাদক সেবনে বহিষ্কার
ঢাবি ভাস্কর্য বিভাগের সপ্তাহব্যাপী বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাওয়ার হাউজ ও কার্জন হলের পাশে কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দেওয়াল অরক্ষিত অবস্থায় আছে। এসময় কয়েকজনকে এ দেওয়াল টপকে পার হতেও দেখা যায়। মাঠের শেষপ্রান্তে ফুটবল খেলতে থাকা কয়েকজন বহিরাগতকে পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে একজন শুধু প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন। বাকিরা মেডিকেল কলেজের পাশের দেওয়াল ডিঙিয়ে এসেছেন।

ঢাবির এবড়োখেবড়ো মাঠে খেলতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা
জিমনেসিয়ামে সরঞ্জাম অপ্রতুল এবং অধিকাংশই পুরোনো হয়ে গেছে/ছবি: জাগো নিউজ

মুরসালিন নামের একজন বলেন, তিনি আগে থেকেই এখানে খেলেন। তাকে প্রবেশের সময় চেক করে না, চেনে সবাই।

আরেকজন বলেন, তারা ছোটবেলা থেকেই এদিকে খেলাধুলা করেন।

খেলার সরঞ্জামের অপ্রতুলতা
কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ এবং জিমনেসিয়ামে খেলার সরঞ্জাম অপ্রতুল এবং অধিকাংশই পুরোনো। এছাড়া পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে খেলোয়াড় তৈরি ব্যাহত হচ্ছে।

শিক্ষার্থী মুনতাসির নাসিফ বলেন, ‘মাঠে গ্যালারিতে বসার জায়গাগুলো যেন কাদা-ধুলা তৈরির কারখানা। জিমনেসিয়াম পুরোনো কিছু যন্ত্রাংশের গুদাম। খাওয়ার পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। জিমনেসিয়ামে নতুন যন্ত্রাংশ খুবই জরুরি এবং প্রতিটি ইনডোর গেমের জন্য আলাদা জায়গা করা উচিত।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের এখানে পর্যাপ্ত নার্সিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ভালো খেলোয়াড় তৈরি হয় না। মাঠে প্রাকটিস নেটের সংখ্যা কম। একটি টিম প্রাকটিস করলে বাকি টিমের অনেক সময় অপেক্ষা করে নেট ধরা লাগে। ফলে যথাযথ প্রাকটিসের অভাবে ভালো পারফরম্যান্স করা সম্ভব হয় না। মাঠের অবস্থাও শোচনীয়, যেখানে গ্যালারি পর্যন্ত নেই।’

শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ
শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যার কথা জানালেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। ডাকসু নির্বাচনের পর এ নিয়ে আশার সঞ্চার হলেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় তারা হতাশ।

শিক্ষার্থী মাফিজুল হাসান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ডাকসু নির্বাচন হওয়ায় আমরা আশা করেছিলাম যে এ অবস্থার উন্নতি হবে, কিন্তু তাও হলো না।’

আহত শিক্ষার্থী সুষম অভিযোগ করেন, ‘ঢাবি প্রশাসন বা ডাকসুর কোনো নজরদারি নেই এসব নিয়ে। ডাকসুর ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদককে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ছাড়া দেখিনি কখনো।’

আহাদুর রহমান বলেন, আন্তবিভাগ খেলা চলছে অথচ কোনো হাইপ নেই। এবার ডাকসু হওয়ায় হাইপ থাকার কথা ছিল বেশি।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে
মাঠের বিষয়ে কথা হলে ডাকসুর ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আরমান হোসেন জানান, মাঠ নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো বৃষ্টিতে পানি জমে। এর কারণ হলো, মূল রাস্তা থেকে মাঠ প্রায় তিন ফুট নিচু। এ অবস্থা নিরসনে মাঠ উঁচু করতে হবে, যাতে খরচ হবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। এটি নিয়ে তিনি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কথা বলেছেন যেন তারা দ্রুত মেগা প্রকল্প শুরু করে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই নষ্ট বাতিগুলো পরিবর্তন করিয়েছেন এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানোর জন্য দ্রুত একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় মাঠের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এস এম জাকারিয়া জানান, মাঠ তৈরি করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের সময়। পরে রাস্তা উঁচু হলেও মাঠ উঁচু হয়নি। যে কারণে অল্প বৃষ্টিতেই এখানে পানি জমে কাদা হয়ে যায়। তিনিও মাঠের সমস্যা সমাধানে মেগা প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেন।

নিরাপত্তা নিয়ে তিনি স্বীকার করেন যে মেডিকেলের পাশের দেওয়াল নিচু হয়ে গেছে এবং এতে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে।

বহিরাগতদের আসার বিষয়ে এস এম জাকারিয়া বলেন, জন্মলগ্ম থেকে এটি হয়ে আসছে।

এ ব্যাপারে কথা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি এক বছর ধরে এটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি, বিশেষ করে দেওয়াল উঁচু করে যেন বহিরাগত ঠেকানো যায়। কিন্তু টাকা নেই বলে আমার এই ফাইল ফেলে রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বন্ধের সময় আমি আমার টিম নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করি।’

এফএআর/একিউএফ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article