তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যুগোপযোগী সংশোধন করা জরুরি বলে মনে করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার।
বুধবার (২২ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও তরুণদের সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা: তরুণ চিকিৎসকদের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, তামাক এমন এক নীরব ঘাতক, যা শুধু ফুসফুস নয়—হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রতিদিন শত শত মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছে তামাকজনিত রোগে, যা আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় অন্তরায়। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যুগোপযোগীভাবে সংশোধন করা জরুরি।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করবো, যেন আইনটি দ্রুত সংশোধন হয়।
সেমিনারে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে ডা. ফারজানা রহমান মুনমুন তুলে ধরেন, গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভে (২০১৩) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছেলেদের ৯.২ শতাংশ এবং মেয়েদের ২.৮ শতাংশ ধূমপান করে। একই বয়সী ছেলেদের ৬.২ শতাংশ ও মেয়েদের ২.৯ শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ পাবলিক স্থানে এবং ৩১.১ শতাংশ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।
সেখানে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে কিশোরদের মধ্যে তামাক ও ই-সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। তামাক কোম্পানিগুলো তরুণদের লক্ষ্য করে ডিজিটাল মাধ্যমে আগ্রাসী বিপণন চালাচ্ছে, যা এই বৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। তাই তরুণদের সুরক্ষায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী দ্রুত পাস করতে হবে।
সেমিনারে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশ হাইপারটেনশন কন্ট্রোল ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, তামাকের ধোঁয়া শুধু ধূমপায়ীকেই নয়—আশপাশের মানুষকেও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরোক্ষ ধূমপান শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। দেশে ১৫ বছরের নিচে ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগছে। এ বিপদ থেকে সুরক্ষা পেতে পাবলিক প্লেস ও পরিবহন থেকে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান (ডিএসএ)’ বাতিল করা জরুরি।
তিনি বলেন, পাশাপাশি বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্যের প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে, যেন শিশু-কিশোররা এসব দেখে তামাকের প্রতি আকৃষ্ট না হয়। এছাড়া তামাক কোম্পানির তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কারণ এসব কার্যক্রম তরুণদের প্রলুব্ধ করে। অধূমপায়ী ও তরুণদের সুরক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুত সংশোধন করা এখন সময়ের দাবি।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী বলেন, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগসহ নানা অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ তামাক। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহার করেন এবং প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রতিবছর তামাকজনিত কারণে এক লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ অকালে মারা যায়। তরুণ প্রজন্মকে এ বিপদ থেকে রক্ষায় প্রস্তাবিত আইন সংশোধনী দ্রুত পাস করা জরুরি।
সেমিনারে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৬টি নীতিগত সুপারিশ তুলে ধরা হয়— সব পাবলিক স্থান ও গণপরিবহনে ধূমপানের নির্ধারিত স্থান বাতিল; বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ; তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ; শিশু-কিশোরদের সুরক্ষায় ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ; তামাকপণ্যের খুচরা ও খোলা বিক্রয় বন্ধ; সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা।
প্ল্যাটফর্ম ডক্টরস ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি ডা. রামিসা ফারিহার উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) শেখ মোমেনা মনি, ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) আখতারউজ-জামান; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপদেষ্টা নাইমুল আজম খান, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর ডা. অরুনা সরকার এবং সিনিয়র কমিউনিকেশন অফিসার আবু জাফরসহ তামাকবিরোধী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
এসইউজে/এমকেআর/জিকেএস