তিস্তার বন্যায় কৃষকের স্বপ্ন ভাসছে অনিশ্চয়তার অথৈ জলে
তিস্তা নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে হাজারো কৃষকের স্বপ্ন। দুদিন আগেও যেখানে দোল খাচ্ছিল সবুজে ভরা ধানের ক্ষেত, এখন সেখানে শুধু পলি, কাদা ও বালু ছড়িয়ে আছে। নদীর পানি নেমে গেলেও ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। ক্ষেতের ওপর জমে থাকা পলি ও বালুর স্তর ফসলের চরম দুর্দশার কথা জানাচ্ছে।
বর্তমানে তিস্তার চর ও নিম্নাঞ্চল যেন এক বিশাল বালুরাজ্যে পরিণত হয়েছে। পানি নেমে গেলেও ক্ষেতের ওপর কাদা, পলি ও বালুর স্তর পড়েছে। অনেক কৃষক বাঁশ পুঁতে ছোট বাঁধ বানিয়ে জমি বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তবে চোখেমুখে এখন শুধু হতাশা, বেঁচে থাকার লড়াই ও অনিশ্চয়তার ছাপ।
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের কৃষক হাসেম আলী ধারদেনা করে পাঁচ বিঘা জমিতে রোপা আমন ধান চাষ করেছিলেন; কিন্তু সব ফসল তলিয়ে গেছে। ভোরে জমি দেখতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি। হতাশার সুরে তিনি বলেন, ধান দেখেই কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। চারা কিনতে ধারদেনা করেছি। এখন সব শেষ। জমি কাদামাটিতে ঢেকে গেছে। সংসার কীভাবে চলবে, আল্লাহই জানেন।
একই গ্রামের জালাল উদ্দিনের জমিও টানা ৯ দিন পানির নিচে ছিল। ধানগাছের পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে গেছে, কিছু পাতা পচে নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ৯ দিন ধরে ফসল পানির নিচে। এখন জমিতে কাদা, পলি ও বালুর স্তর। মনে হয় জীবনটাই পানিতে ভেসে গেল।
তিস্তা পাড়ের কৃষক রজব আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ত্রাণ দিয়ে কী হবে? ফসল বারবার পানিতে তলিয়ে গেলে আমরা বাঁচতে পারব না। স্থায়ী বাঁধ ও সেচের ব্যবস্থা ছাড়া আমাদের টিকে থাকা কঠিন।
জানা গেছে, চলতি মৌসুমে চার দফা বন্যায় উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় কৃষিজমি, সবজি ক্ষেতসহ বসতভিটার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, নদী তীরবর্তী সমতলের প্রায় ৮০ শতাংশ রোপা আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় প্রায় ৫৪৩ একর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
খালিশা চাপানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান বলেন, 'তিস্তাপাড়ের কৃষকরা প্রতি বছরই এমন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ত্রাণ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। বিশেষ করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও আধুনিক সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
টেপাখরিবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন বলেন, আমার ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী চারটি ওয়ার্ডের কয়েক হাজার কৃষক নিঃস্ব হয়েছেন। জমিতে কাদা ও বালুর স্তর থাকায় পুনর্বাসন প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে। শুধু সরকারি সহায়তা নয়, স্থানীয়ভাবে কৃষি পুনর্বাসন তহবিল গঠনও জরুরি।
ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হাসান আল বান্না বলেন, ডিমলা ভৌগোলিকভাবে উজানে হওয়ায় পানি দ্রুত নেমেছে। তবে জমিতে এখনো কাদা, বালু ও পলির স্তর জমে আছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি এবং কৃষকদের বন্যা-পরবর্তী করণীয় জানিয়েছি। রবি মৌসুমে কৃষি বিভাগের প্রণোদনা কার্যক্রমের আওতায় তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সরকারি প্রণোদনা ও পুনর্বাসনসহ সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। এরই মধ্যে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন (জিআর) চাল বিতরণ করা হয়েছে এবং আরও চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।