থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যা, ১০ মাসে ঝরেছে ২৯ প্রাণ

1 month ago 14

দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থামছেই না। গত দুই দশকে ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার’- এরকম নামে চলে আসছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় বক্তব্যও গৎবাঁধা—প্রতিপক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালালে আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ছোড়ে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়াও একটি বড় উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হলো। এসময়েও বন্ধ হয়নি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।

মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর তথ্য বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২৯ জন। এরমধ্যে নির্যাতনে ১১ জন, গুলিতে ১৩ জন এবং পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২৯ জন। এরমধ্যে নির্যাতনে ১১ জন, গুলিতে ১৩ জন এবং পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।- অধিকারের তথ্য

গত বছরের সেপ্টেম্বরে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের, গুলিতে নিহত হয়েছেন ৪ জন। অক্টোবরে নির্যাতনে একজন ও নভেম্বরে নির্যাতনে একজন মারা গেছে। ডিসেম্বরে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে একজনের। গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। ফেব্রুয়ারিতে গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনজন। মার্চে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে একজনের। এপ্রিলে গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন। মে মাসে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে একজনের, গুলিতে নিহত হয়েছেন দুজন এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে একজনকে। জুনে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে একজনের এবং গুলিতে নিহত হয়েছেন দুজন।

থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যা, ১০ মাসে ঝরেছে ২৯ প্রাণ

বিগত ১০ মাসে ঘটে যাওয়া এসব হত্যাকাণ্ডকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে মনে করছে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘একজন ব্যক্তি অপরাধী হতে পারে। কিন্তু একজন অপরাধীকেও ভালো হওয়ার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন এবং সে অধিকার তার আছে।’

কোনোভাবেই যেন একজন অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারের আগে মৃত্যু না হয়। কারও যেন অভিযোগ না থাকে যে নির্যাতন করে বা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলা হয়েছে।- ড. তৌহিদুল হক

‘সেই জায়গা থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যখন হয়, বিগত ১৫ বছরে যখন এই অভিযোগগুলো এসেছে এবং তার আলামত পাওয়া গিয়েছে, আমরা কিন্তু নানাভাবে সেটি সমালোচনা করেছি। এটি বন্ধের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগের বিষয়েও কিন্তু বলা হয়েছে।’

ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো ব্যক্তি নির্যাতিত হবে না, নিপীড়ন-হামলা-মামলার শিকার হবে না এটা তো আমাদের খুব স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু এই সময়ে বা এই সরকারের সময়েও সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না।’

‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে ধরনগুলো আমরা দেখি, পুলিশি হেফাজতে অথবা নির্যাতনের কারণে, কিংবা পুলিশ গ্রেফতার করার সময় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় মৃত্যু, আবার অভিযানের সময়ও অনেকের মৃত্যু হয়েছে।’

এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো ক্ষমতার বাইরে থেকে মানুষের অধিকারকে যেভাবে দেখা হয়, ক্ষমতায় বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সময় দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে যায়। এটিও কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।’

‘তিনটি জায়গাতে পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামানো যাবে না। প্রথম, যেকোনো ধরনের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার কিংবা ব্যাপক পরিসরে তার মানবাধিকারের বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর সোচ্চার থাকতে হবে। কোনো দল বিরোধী দলে থাকলেও যে কথা বলবে সরকারে গেলেও একই কথা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’

এক্সট্রা জুডিসিয়াল কিলিং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। কোনোভাবেই কাম্য না। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে। মব ভায়োলেন্স করে পিটিয়ে হত্যাও কোনো মানবতা না। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, সভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধ।- অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব

‘দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে একজন অপরাধীকে যে দৃষ্টিতে দেখা হয়, কিন্তু এটা ভাবা হয় না একজন অপরাধী তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও বড় দায় আছে। আমাদের এখানে অনেকের জীবন অপরাধমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য রাষ্ট্র ন্যূনতম স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অথচ সেটা দেওয়া গেলে তারা হয়তো অপরাধী হতো না কিংবা সুন্দর জীবনে ফিরে আসতো। অপরাধীকে বিচারের মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থা করা উচিত। সেই সুযোগ বা অধিকার একজন অপরাধীর থাকতে হবে।’

‘বিভিন্ন দেশগুলোতে যারা অপরাধীদের সংশোধন করে আইন মান্যকারী বা সমাজ উপযোগী নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, তারা কিন্তু এ প্রক্রিয়াতেই করেছে।’

‘তৃতীয়ত, অপরাধ তদন্ত, অপরাধীদের গ্রেফতার, আইন প্রয়োগ, বিচারব্যবস্থার বিষয়ে সর্বোচ্চ সোচ্চার থাকতে হবে। যেন কোনোভাবেই একজন অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারের আগে মৃত্যু না হয়। কারও যেন অভিযোগ না থাকে যে নির্যাতন করে বা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলা হয়েছে।’

থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যা, ১০ মাসে ঝরেছে ২৯ প্রাণ

ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় কোনো সমাধান আসবে না। বরং এতে ক্ষোভ আরও বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কিংবা আইন প্রয়োগের জায়গাতে বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়বে।

‘এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু অনেক কিছুই হয়েছে। যেসব ব্যাপারগুলো হওয়ার কথা ছিল না তার মধ্যে বিচারবহিভূত হত্যাকাণ্ড অন্যতম’- যোগ করেন এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে বাদ দিলাম, একজন নাগরিক হিসেবে কোনো একটি হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করি না। যেকোনো হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক, আমি নিন্দা জানাই। এক্সট্রা জুডিসিয়াল কিলিং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। কোনোভাবেই কাম্য না। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘মব ভায়োলেন্স করে পিটিয়ে হত্যা কোনো মানবতা না। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, সভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এটিকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। যারাই দায়ী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন বদলাতে হবে। কিন্তু অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতেই হবে।’

কেআর/এমকেআর/এএসএম

Read Entire Article