দক্ষিণ এশিয়ায় কমেছে চরম দারিদ্র্যে বসবাস করা শিশু

13 hours ago 6

গত এক দশকে বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে সাফল্য সব অঞ্চলে সমান নয়। যুগান্তকারী অগ্রগতি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার। ২০১৪ সালে এ অঞ্চলে প্রায় ২৫ শতাংশ শিশু চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতো, ২০২৪ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ শতাংশে।

এ সাফল্যে ভারতের ভূমিকা বেশি। দেশটিতে ২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শিশুদের চরম দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৫ শতাংশের নিচে। এ হিসাব দৈনিক তিন ডলারের কম আয়ের ক্ষেত্রে। তবে দৈনিক ৮ দশমিক ৩০ ডলার (১ হাজার ৪ টাকা) আয়ের দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী এখনো দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৮৫ শতাংশ শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে, যা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অসাম্যের গভীরতা তুলে ধরে।

বিশ্বব্যাংকের পোভার্টি অ্যান্ড ইনইক্যুয়ালিটি প্ল্যাটফর্ম এবং হালনাগাদ বৈশ্বিক দারিদ্র্যসীমার আলোকে, বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফ যৌথভাবে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে গত এক দশকে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও নির্দিষ্ট কিছু দেশের শিশুদের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি তথ্যভিত্তিক চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এতে ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৪১২ মিলিয়ন বা বিশ্বের শিশু জনসংখ্যার ১৯ শতাংশের বেশি প্রতিদিন তিন ডলারের কম (৩৬৩ টাকার কম) আয় নিয়ে জীবনযাপন করছে। এ সংখ্যা ২০১৪ সালে ছিল ৫০৭ মিলিয়ন বা ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ, গত এক দশকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন শিশু চরম দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে, যদিও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অস্থায়ীভাবে অগ্রগতিতে ধাক্কা লেগেছিল।

জাতীয় মাল্টিডাইমেনশনাল দারিদ্র্য সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি দশজন শিশুর মধ্যে প্রায় তিনজন, অর্থাৎ ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের (২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ) তুলনায় বেশি। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি), ইউনিসেফ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সূচকটি প্রস্তুত করা হয়।

সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে জাতীয় শিশু দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যার মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় হার উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। শহরাঞ্চলে এ হার যেখানে ৮ দশমিক ২২ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ।

বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রংপুরে শিশু দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ ২৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, যার পরই রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ, ২৪ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে। ঢাকায় শিশু দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম, মাত্র ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে এহার ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

একদিকে দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিশুদের জন্য আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন ঘটেছে, অন্যদিকে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকায় দারিদ্র্য অব্যাহত রয়েছে।

২০২৪ সালেও সাব-সাহারান আফ্রিকা বিশ্বের চরম শিশু দারিদ্র্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। এখানকার ৫২ শতাংশের বেশি শিশু প্রতিদিন তিন ডলারের কম আয় নিয়ে জীবনযাপন করছে, যা ২০১৪ সালের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত।

অথচ বিশ্বজুড়ে চরম দারিদ্র্যে থাকা প্রতি চার শিশুর মধ্যে তিনজনই এ অঞ্চলের, যদিও বৈশ্বিক শিশু জনসংখ্যার মাত্র ২৩ শতাংশ এখানে বাস করে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সহিংসতা, জলবায়ু দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এ অঞ্চলে দারিদ্র্য হ্রাসকে কঠিন করে তুলেছে।

পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। চরম শিশু দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমেছে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেখানে ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শিশু দারিদ্র্য ২৬ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমেছে এবং প্রায় দুই কোটি শিশু দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে। ৮ দশমিক ৩০ ডলারের দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী, এ অঞ্চলে শিশু দারিদ্র্য ৫৯ শতাংশ থেকে কমে ৩৭ শতাংশ হয়েছে, যার পেছনে চীনের বড় অবদান রয়েছে।

তবে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে অসমতা রয়ে গেছে। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর এ অঞ্চলে চরম শিশু দারিদ্র্য ২০২৪ সালে ৮ শতাংশের নিচে নেমেছে, যা ২০১৪ সালে ছিল ১০ শতাংশের বেশি। কিন্তু ৮ দশমিক ৩০ ডলারের মানদণ্ডে এখনো ৪১ শতাংশের বেশি শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, যা আঞ্চলিক অসমতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরে।

ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার উন্নতি স্থিতিশীল। এ অঞ্চলে শিশু দারিদ্র্যের হার ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ধীর কিন্তু ইতিবাচক অগ্রগতির প্রতিফলন।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিশ্বের একমাত্র অঞ্চল যেখানে চরম শিশু দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে হার ছিল ৭ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৩ শতাংশের বেশি। ইয়েমেনসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ৮ দশমিক ৩০ ডলারের মানদণ্ডে এখানকার শিশু দারিদ্র্য ৬০ শতাংশের কাছাকাছি রয়ে গেছে।

এই প্রতিবেদন বলছে, শিশুদারিদ্র্য হ্রাস সম্ভব—এমনকি বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও। তবে এখনো প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের জন্য উন্নয়নের গতি পিছিয়ে আছে। আঞ্চলিক বৈষম্যও রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাসের যাত্রায় শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এটি শুধুই নৈতিক কর্তব্য নয়, একই সঙ্গে এটি ভবিষ্যতের জন্য সর্বোত্তম বিনিয়োগ।

আইএইচও/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article