দুধকে আদর্শ খাবার বলা হয় কেন?

4 months ago 58

শরীর সুস্থ এবং কর্মক্ষম রাখতে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার অপরিহার্য। এই অপরিহার্য খাদ্যদ্রব্য সম্পর্কিত কার্যক্রমে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এ বছরও ১ জুন পালন করা হচ্ছে ‘বিশ্ব দুগ্ধ দিবস’। ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব দুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘বৈশ্বিক পুষ্টিতে দুধ অপরিহার্য’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা দরকার। যা বাংলাদেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মেনে চলেন। যদিও দেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে, তারপরও সাধারণ মানুষ এখনো প্রয়োজনের তুলনায় কম দুধ পান করেন। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল জোগান, দুধের উৎপাদন বিভিন্ন কারণে কম হওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, জনসচেতনতার অভাব, জনস্বাস্থ্য নিয়ে অজ্ঞতা প্রভৃতি।

দুধকে বলা হয় আদর্শ খাবার। মানবজীবনের শুরু হয় দুধ দিয়ে। শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষের জন্যই দুধ প্রয়োজনীয় খাবার। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু জন্মের পর বিভিন্ন কারণে ঠিকভাবে দুধ পান করতে পারে না, তারা অধিকাংশ সময়ই নানা ধরনের অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে। দুধের অপরিহার্য উপাদান হলো ল্যাকটোজ, যা দৈহিক গঠন ও মেধাবিকাশে সাহায্য করে। দুধে আরও আছে অ্যামিনো অ্যাসিড, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, যেমন ক্রোমিয়াম, আয়রন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিংক ও আয়োডিন। আনুপাতিক হিসাবে গরুর দুধে পানি থাকে ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ল্যাকটোজ থাকে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, চর্বি থাকে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, প্রোটিন থাকে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

দুধে বিদ্যমান বিভিন্ন খনিজ লবণের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্যালসিয়াম। মানুষের হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। এ ছাড়া দুধ ভিটামিন ডি’রও ভালো একটি উৎস। ভিটামিন ডি হাড়, দাঁত, নখ, চুল ও ত্বকে পুষ্টি জোগায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে। দুধে আরও আছে ভিটামিন এ, যা সব বয়সের মানুষের চোখের জন্য উপকারী। দুধের মধ্যে আছে ফোলেট ও ম্যাগনেশিয়াম, যা আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে এবং রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। দুধে বিদ্যমান আয়োডিন শরীরে থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভিটামিন-বি বেরিবেরি অসুখ প্রতিরোধ করে ও স্নায়ুকে রাখে কর্মক্ষম। আসলে দুধে যেসব পুষ্টি উপাদান আছে- শরীর গঠনে সেসবের অবদান লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। নিজে সুস্থ থাকার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মকেও শক্তি, বুদ্ধি ও সুস্থতার সঙ্গে গড়ে তুলতে সামর্থ্য অনুযায়ী তাই নিয়মিত দুধ পান করা উচিত।

শিশুর জন্মের পর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধই একমাত্র ও আদর্শ খাবার। ছয় মাস পর থেকে শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণে তথা স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খাওয়ানো দরকার। মায়ের দুধে সব ধরনের খাদ্য উপাদানই থাকে। এ ছাড়া জন্মের পরপরই মায়ের স্তন থেকে যে হলুদ রঙের শালদুধ নিঃসরিত হয়, তা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মায়ের দুধ সহজপাচ্য, বিশুদ্ধ এবং এতে রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান থাকে বলে যে কোনো সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। মায়ের দুধ পানকারী শিশুর হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, স্থূলতা, টাইপ-১ ডায়াবেটিস, কানের প্রদাহ, ডায়রিয়া, বমি, সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম ইত্যাদির আশঙ্কা কম থাকে। যে মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ পান করান, তাদেরও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্তন ও জরায়ুর ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। কিন্তু বাজারের যেসব শিশুখাদ্য পাওয়া যায়, সেগুলো মায়ের দুধের মতো এতটা সুরক্ষা দিতে পারে না। ফলে শিশু ও নবজাতকের নানা রকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

নবজাতককে দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখা জরুরি। নবজাতকের পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাকে অবশ্যই সুষম খাবার খেতে হবে। প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর আগে মাকে এক থেকে দুই গ্লাস পানি অথবা তরল খাবার খেতে হবে। দুধ খাওয়ানোর সময় কোনো রকম তাড়াহুড়া করা যাবে না। প্রশান্ত মনে ও ধৈর্যসহকারে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। মা বসে খাওয়াতে চাইলে মায়ের পিঠের পেছনে এবং কোলের নিচে বালিশ নিয়ে আরাম করে বসতে পারেন। শুয়ে খাওয়াতে চাইলে শিশুকে মায়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে এমনভাবে শুইয়ে দিতে হবে, যেন মা হাত দিয়ে শিশুর পশ্চাদ্দেশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন। শিশুর নাক যেন চাপে না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবার দুধ খাওয়ানোর সময় একটি স্তন থেকেই ভালোভাবে খাওয়াতে হবে। কারণ একই স্তন থেকে প্রথমদিকে পাতলা এবং পরে ঘন দুধ বের হয়। দুই ঘণ্টা পরপর শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে। তবে রাতে ঘুমানোর সময় একটানা চার ঘণ্টা বিরতি দিলেও কোনো সমস্যা নেই।

কর্মজীবী মায়েরা কাজে থাকাকালীন শিশুর যাতে বুকের দুধের অভাব না হয়, সে জন্য বুকের দুধ সংরক্ষণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কাজ থেকে ফিরে যতবার শিশুকে দুধ খাওয়াবেন, ততবার স্তন থেকে দুধ পাম্প করে তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করবেন। তবে ফ্রিজ থেকে সাথে সাথেই বের করে ঠান্ডা দুধ শিশুকে দেওয়া যাবে না। একটি পাত্রে গরম পানিতে দুধের পাত্র রেখে নেড়ে নেড়ে শিশুর খাওয়ার জন্য সহনীয় তাপমাত্রায় আনতে হবে। এ ছাড়া মা যদি করোনায় সংক্রমিত হন, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে কোনো বাঁধা নেই। এরকম ক্ষেত্রে মা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে মাস্ক পরে শিশুকে দুধ পান করাবেন। তবে মা যদি সক্রিয় যক্ষ্মা, এইডস, হিউম্যান টি সেল লিম্ফোট্রফিক ভাইরাস ইত্যাদিতে সংক্রমিত থাকেন কিংবা কোনো মাদকদ্রব্য সেবন করেন বা ক্যান্সারের জন্য কেমোথেরাপি চিকিৎসা নেন, তাহলে শিশুকে স্তন্যদান থেকে বিরত থাকা উচিত। শিশু যদি গ্যালাক্টোসেমিয়া, ফিনাইলকিটোনিউরিয়া বা ম্যাপল সিরাপ ইউরিন ডিজিজ ধরনের জন্মগত মেটাবলিক রোগে ভোগে, তাহলেও শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এ ধরনের ক্ষেত্রে শিশুকে বিশেষায়িত ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

দুধের পরিপূরক অন্য কোনো খাবার কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। তাই শিশুদের জন্য যেমন মায়ের বুকের দুধ অপরিহার্য, তেমনই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্যও গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে সবার জন্য পুষ্টির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করাই হোক বিশ্ব দুগ্ধ দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিসিন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article