দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’

4 months ago 36

দুর্নীতিবাজদের নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞাটা দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়, সে দুর্নীতিবাজ; যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ; যে হোর্ড করে, সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে,তারাও দুর্নীতিবাজ।’এর চেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা আর কি হতে পারে। আমাদের সমাজে অভাবে কেউ দুর্নীতি করে না, সীমাহীন লোভের বশীভূত হয়েই দুর্নীতি করে। দুর্নীতি আজ ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অধিকাংশ অপরাধের অন্যতম প্রধান উৎস হলো দুর্নীতি। এটি এমন একটি ব্যাধি, যা সমাজের মূল কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়।

বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই দুর্নীতির খবর চাউর হয়। পুকুর চুরি, সাগর চুরি এসব খবরে জনগণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও জাতীয় রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সেটা সত্য হলে চুরির মহাসাগর বললেও কম হবে। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠার পরই দ্রুত অনুসন্ধানের সিন্ধান্ত নেয় দুদক।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাকে ও পরিবারের সদস্যদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে ব্যাংক হিসাব ও অস্থাবর সম্পতি ক্রোক করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের পূত্রের ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে ছাগল কেনা নিয়ে খবর হওয়ার পরই তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠার পর সরকার দ্রুতই মতিউর রহমানকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

জন আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিয়ে বেনজীর আহমেদের সকল সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেয়া কিংবা মতিউর রহমানকে সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এমন ত্বরিৎ সিন্ধান্ত সরকারের প্রতি জনমনে আস্থা আরো গভীর হবে। এসব কার্যক্রমে কিছুটা হলেও দুর্নীতিবাজরা ভয় পাবে। শেখ হাসিনার আমলে যে যতই ক্ষমতাশালী হোন না কেন, কেউ ছাড় পাবে না- এমন বার্তা স্পষ্ট হয়েছে।

পর পর এতবড় দুজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার দুর্নীতি প্রকাশের পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বেনজীর ও মতিউর ইস্যু টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। পাড়ার চায়ের টেবিল থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে। বেনজীর আহমেদ পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ আইজিপি, র‌্যাব, ডিএমপি কমিশনারসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

সেসময় গুলোতে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সফলতার কারণে জনগণের মধ্যে একটা আস্থার জায়গা তৈরি করেছিলেন। এটা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ যে অভিযোগ উঠেছে, এটা সবাইকে বিস্মিত করেছে। অন্যদিকে মতিউর রহমানের পারিবারিক যে ইতিহাস গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, তাতে মনে হয় ‘সর্ষের মধ্যে ভূত' আরো অনেক লুকিয়ে আছে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির ইতিহাস নতুন নয়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়কালে সামরিক শাসনামলে রাষ্ট্রীয় মদদে দুর্নীতি শুরু হয়। সে ধারা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের (২০০১-০৫) শাসনামলেও চালু ছিল। তখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। দুর্নীতির বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের কাছে দেশের মর্যাদা অত্যন্ত লজ্জাজনক ছিল। তখন তো দুর্নীতি একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। জনগণ দুর্নীতিবাজদের কাছে অসহায় ছিল।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার করেছে। ইশতেহার পুস্তিকার (চ) ধারায় বলা হয়েছিল, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুনীতি। দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে।’এটাই শেখ হাসিনার সরকারের অঙ্গীকার। সরকার সেলক্ষ্যই কাজ করে যাচ্ছে।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কয়েক দফায় বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু ঘুষ দুর্নীতি আশানুরূপ কমেনি। বর্তমান বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন দ্বিগুণ করা হলেও এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘পে স্কেলে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে হারে বেতন বেড়েছে, তা বিশ্বে বিরল। তাই জনগণ যাতে সেবা পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বেতন সেহেতু বেড়েছে তাই ঘুষ দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।'

বেতন ভাতা বাড়ানোর কারণে বহু মেধাবী তরুণদের কাছে সরকারি চাকরি লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বেতন ও অবসর ভাতা মিলিয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের প্রায় পনের শতাংশ। সরকারি চাকরিজীবীদের বহু সুবিধার পরও যারা মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতি করে আসলে তারা অভাবে নয়, স্বভাবে করে।

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সেক্টরকে ডিজিটাইজেশন করা হয়েছে। যার কারণে জনগণের ভোগান্তি হ্রাস, অনলাইন টেন্ডার, দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ বিনা খরচায় ১০৬ নম্বরে ফোন করে জানাতে পারছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় অর্থায়ন বাড়ানো হয়েছে। বিচারের কাজে গতি আনা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্তে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন,নাগরিক সনদ রচনা, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ণ এবং অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তাঁর সময়কালে বেশ কয়েকবার দুর্নীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছেন। সেখানে দলীয় নেতা কিংবা প্রভাবশালী কাউকে ছাড় দেয়া হয়নি। তাকে অপরাধীকে হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। দলের অনেক নেতাকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিলেন। তখন ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলীয় নেতাকর্মীদের কাউকে ছাড় দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র এসব অনিয়মের কারণে অনেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে।

দুর্নীতি সরকার একা বন্ধ করতে পারবে না। এর বিরুদ্ধে দরকার সামাজিক আন্দোলন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজে দেখা যায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদেরকেই প্রধান অতিথি করা হয়, যারা বেশি অর্থ দিতে পারবে। তাদেরকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে রাখা হয় যারা অনুদান দিতে পারবে। অথচ আযোজকরা একবারও তার আয়ের উৎস বিবেচনা করেন না।

সমাজের একশ্রেণির মানুষ দুর্নীতিবাজদের টাকার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে যাচ্ছে। সমাজ এতটাই নষ্ট হয়ে গেছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রী কি়ংবা পরিবার চিন্তা করে পাত্রের চাকরির পদমর্যাদার চেয়ে উপরি ইনকাম আছে কিনা?, সেটিই বিবেচনা করে। এখন ঘুষ খাওয়াকে কিছু লোক ফ্যাশন বা স্মার্টনেস বলেই মনে করে।

অনেক সময় দেখা যায়, দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যান। আবার কখনো আমলে নেওয়ার পরও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া ব্যাহত কিংবা দীর্ঘায়িত হয়। ফলে দুর্নীতি রোধ করাও সম্ভব হয় না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ ও সম্পদ দ্রুত সরকারের হেফাজতে নিতে হবে। যখন দেখা যাবে বড় বড় রাঘববোয়ালরা পার পাচ্ছে না, তখন অনেকেই দুর্নীতি করতে সাহস পাবে না। তবে আশার কথা হলো গুটিকয়েক ব্যক্তি দুর্নীতি করলেও এখনো অধিকাংশ মানুষই সৎ। যার সুফলও পাচ্ছে দেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি (অর্থাৎ দুর্নীতিকারী যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে, তার কোনো ছাড় নেই) গ্রহণ করে চলেছেন। তিনি কোনো অন্যায় অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন না। ২০১৯ সালে অক্টোবরে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান যদি না চালাই, তাহলে আমাদের সমাজে একটা বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাবে। সমাজে একজন যখন একজন সৎভাবে জীবনযাপন করছে,আরেকজন একই কাজ করেও দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল অর্থের মালিক হচ্ছে। তাদের জীবনযাপনে সেই বৃত্তের প্রকাশ ঘটানো হচ্ছে ‘অসুস্থভাবে’। এর প্রভাব পড়ছে ছেলেমেয়েদের ওপর। সম্পদ দেখানোর একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা, একটা অসুস্থ মানসিকতা- এখান থেকে আমাদের সমাজটা রক্ষা করতে হবে।'

প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উপর বাংলার জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা আছে। তিনিও সবসময়ই জনগণের আস্থার প্রতিদান দেন। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। বেনজীর আহমেদ কিংবা মতিউর রহমান দোষী কি নির্দোষ সেটা বিচারের মাধ্যমে ফয়সালা হবে, সেটা সময় সাপেক্ষ্য বিষয়। কিন্তু জন আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিয়ে বেনজীর আহমেদের সকল সম্পত্তি সরকারের হেফাজতে নেয়া কিংবা মতিউর রহমানকে সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এমন ত্বরিৎ সিন্ধান্ত সরকারের প্রতি জনমনে আস্থা আরো গভীর হবে। এসব কার্যক্রমে কিছুটা হলেও দুর্নীতিবাজরা ভয় পাবে। শেখ হাসিনার আমলে যে যতই ক্ষমতাশালী হোন না কেন, কেউ ছাড় পাবে না- এমন বার্তা স্পষ্ট হয়েছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
haldertapas80@gmail

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article