দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানি খাতের ভূমিকা সূদৃঢ় করতে কাজ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তবে বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ এবং আওয়ামী লীগসমর্থিত আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকে টাকা রেখে এখন নিজেরাই আর্থিক চাপে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বারবার তাগাদা দিয়েও অনিয়ম ও দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে পড়া ওইসব ব্যাংক থেকে এখন নিজস্ব তহবিলের টাকা উঠাতে পারছে না খোদ সরকারি সংস্থাটি।
সূত্র জানিয়েছে, ইপিবির ১৭৯ কোটি ৭২ লাখ ২২ হাজার ৯৬১ টাকা আটকে আছে নয়টি বেসরকারি ব্যাংক ও সরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরেও উদ্ধার হচ্ছে না। সেসব প্রতিষ্ঠান হলো ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।
- আরও পড়ুন
- আইএফআইসি, ন্যাশনাল ও এবি ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা শুরু
- এক্সিম ব্যাংকের নজরুলসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
- ব্যাংক আইনে বাতিল হচ্ছে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’র বিধান
- ‘গলার কাঁটা’ খেলাপি ঋণ, ৫ বছরে বেড়েছে ৪ লাখ কোটি টাকা
এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি ছাড়া অন্যগুলো অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিগত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীন ছিল এসব প্রতিষ্ঠান। সেগুলো পরিচালিত হতো এস আলম এবং সরকারের অন্যান্য বড় বড় মন্ত্রী ও আস্থাভাজনদের দিয়ে।
ইপিবি তিনটি তহবিলে ৫৯টি এককালীন স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেছে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানে। তহবিল তিনটি হলো, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রশাসনিক তহবিল, রপ্তানি বাজার উন্নয়ন তহবিল ও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার তহবিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭টি এফডিআরের মাধ্যমে ৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৬ টাকা আটকে আছে ইউনিয়ন ব্যাংকের সাতটি শাখায়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পাঁচটি শাখায় ১৩টি এফডিআরে আটকে আছে ৩৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকা আটকে আছে আইসিবিতে। এর একটি শাখায় তিনটি এফডিআরে আছে ৩১ কোটি টাকা।
- আরও পড়ুন
- পুনঃতফসিল ঋণ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় পৌঁছালো
- ২৩ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে
- বেশিরভাগ ব্যাংকে সাইবার সিকিউরিটি নেই, জনগণের তথ্য অনিরাপদ
- এস আলম ও সিকদার পরিবারসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত
এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের দুটি শাখায় চারটি এফডিআরে আটকে আছে ১৭ কোটি ৪১ লাখ ১৪ হাজার ১৪৬ টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের তিনটি শাখায় সাতটি এফডিআরে ১৭ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখায় তিনটি এফডিআরে নয় কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চারটি শাখায় চারটি এফডিআরে সাত কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় পাঁচটি এফডিআরে ছয় কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের দুটি শাখায় দুটি এফডিআরে চার কোটি টাকা এবং পদ্মা ব্যাংকের একটি শাখায় একটি এফডিআরে আটকে আছে দুই কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইপিবির অর্থ ও হিসাব শাখার একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেহেতু ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই ইপিবি সেখান থেকে টাকা তুলে নিতে চায়। কিন্তু ওইসব ব্যাংক এখন টাকা দিতে পারছে না। এর মধ্যে কেউ কেউ চাপে পড়ে শুধু লভ্যাংশ দিচ্ছে। কেউ বলছে, আবারো নবায়ন করতে; নবায়নের মেয়াদ শেষে একবারে দেবে। বেশিরভাগই এখন নিজেদের ব্যাংকের আর্থিক সংকটের কথা বলছে।’
তাগাদা দিয়েও মিলছে না অর্থ
এদিকে ইপিবির এ সমস্যার বিষয়টি উঠে আসে পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ ১৪৮তম সভায়। সেখানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সভাপতিত্ব করেন।
সভায় জানানো হয়, একাধিকবার চিঠি এবং টেলিফোনে তাগিদ দেওয়ার পরেও ১০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। এরমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ছয়টি পে অর্ডারের মাধ্যম এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা পরিশোধে বারবার ব্যর্থ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অন্যান্য ব্যাংকেরও এফডিআর নগদায়ন করা যাচ্ছে না।
ওই পর্ষদ সভা সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য ব্যাংকের বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে পরিচালনা পর্ষদ। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ নগদায়নের প্রচেষ্টা চালানোর তাগিদ দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে ইপিবির সদ্য বিদায়ী ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, যেসব ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এজন্য ইপিবির অর্থায়নের কোনো সমস্যা নেই। এর বাইরে স্থায়ী আমানত রাখা অন্যান্য ব্যাংকের অর্থ নগদায়ন হচ্ছে।
ইপিবির অর্থ ফেরতের বিষয়ে কথা হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শুধু ইপিবি নয়, আমরা বহু প্রতিষ্ঠানের এফডিআরের টাকা ফেরত দিতে পারছি না। এমনকি ছোট ছোট আমানতকারীর টাকাও এ মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে আলোচনা চলছে, সে কারণে আমরা নতুন আমানতও পাচ্ছি না। পুরোনো বিনিয়োগের রিকভারি হচ্ছে না, ঋণ বিতরণেও নানা অনিয়ম হয়েছে। সব মিলিয়ে ভাঙা ঘর পাহারা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
- আরও পড়ুন
- প্রিমিয়ার ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক
- জুনে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে
- এক্সিম ব্যাংকের ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাতে ২১ জনের নামে মামলা
- শাহজালাল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সাজ্জাতুজ জুম্মা কারাগারে
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো আমানতকারীর টাকা হারাবে না। কয়েকটি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হলে আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাবেন। পদ্মা ব্যাংকের জন্য একটি রোডম্যাপ করা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী আমানত ফেরত দেওয়া হবে। এজন্য তারল্য সহায়তা চাওয়া হয়েছে। গভর্নর বারবার বলেছেন—আমানতকারীরা তাদের টাকাই ফেরত পাবেন, তবে ধৈর্য ধরতে হবে।’
রাজনৈতিক চাপে দুর্বল ব্যাংকে টাকা?
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব এফডিআর করেছে ইপিবি।
ইপিবির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিগত সরকারের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে খুশি করতে সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব ব্যাংকে আমানত রেখেছিলেন। অথচ সেই সময় থেকেই ব্যাংকগুলোকে দুর্বল রেটিং দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যেসব ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল, সেই সব ব্যাংকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের পেনশন, প্রশাসনিক ও বাণিজ্য মেলা তহবিলের টাকা রাখা হয়েছে। এটা শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, এর পেছনে স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনের গন্ধ আছে।’
ঝুঁকি ও প্রশ্ন
দুর্বল ব্যাংকের খারাপ রেটিং থাকা সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের এত বিপুল অর্থ সেখানে রাখা হলো কেন? এর পেছনে কার স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ছিল, তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাছাড়া এফডিআর করার সময় প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তারা তখন কেন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলেন না, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে একই ধরনের ঝুঁকি ভবিষ্যতেও তৈরি হবে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের রপ্তানি খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইপিবির টাকাই যদি আটকে যায়, তাহলে সাধারণ আমানতকারীর নিরাপত্তা কোথায়? রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি আর অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি টাকাই এখন অরক্ষিত। এই ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো—ব্যাংক খাত সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে লাভের আশায় টাকা রাখা হয়েছিল, সেখানে মূলধনই আটকে গেছে। দুর্বল ব্যাংকে বিনিয়োগের ঝুঁকি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।’
এনএইচ/ইএআর/এমএমএআর/জিকেএস