‘এ বছর এখনো ইলিশ খেতে পারিনি। বাজারে চড়া দামে। এর মধ্যে ভারতে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ভেবেছিলাম দাম কমবে। এখন আর খাওয়ার কোনো আশাই থাকলো না।’
সেগুনবাগিচা বাজারে কথাগুলো বলছিলেন সরকারি চাকরিজীবী মনির হোসেন। সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ভারতে ১২শ টন ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে সন্ধ্যায় জাগো নিউজকে তিনি এ প্রতিক্রিয়া জানান।
কিছু দূরে শান্তিনগর বাজারে কথা হয় আরেক ক্রেতা ময়না আক্তারের সঙ্গে। তিনি বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। ইলিশ মাছের দোকানের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। মাছ কিনবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বছর শুধু নয়, চার বছর ঢাকায় আসার পর কখনোই তিনি ইলিশ মাছ কিনতে পারিনি। যে বাড়িতে কাজ করি তারা দেওয়ায় কয়েকবার খেয়েছি।’
ময়না অবশ্য জানেন না ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবর। তবে তিনি বলেন, ‘ছেলেমেয়ে খুব খেতে চায়। কিন্তু কিনতে পারি না, দামের কারণে সাহসে কুলায় না। ইলিশ মাছ খাবো এই সামর্থ্য আমাদের এখনো হয়নি ভাই।’
দেশে অতিরিক্ত দামের কারণে নিম্ন আয়ের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও ইলিশ মাছ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। এক কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকার ওপরে। এত দাম এর আগে কখনো হয়নি। ঠিক এমন পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন দুর্গাপূজায় ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে।
আরও পড়ুন
ভারতে যাচ্ছে ১২০০ টন ইলিশ, প্রতি কেজির দাম কত?
আকাশছোঁয়া ইলিশের দাম ফের বেড়েছে, অন্য মাছও কেনা দায়
পূজার আগেই আসবে বাংলাদেশের ইলিশ, আশায় বুক বেঁধেছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ
গুজরাটের ইলিশে সয়লাব কলকাতা, পূজার আগে তাকিয়ে বাংলাদেশের দিকে
ইলিশের এ মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, এবার মৌসুমের শুরু থেকেই ইলিশের দাম চড়া। রপ্তানির সিদ্ধান্ত বাজারে দাম আরও উসকে দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্নচিত্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাজারগুলোতে। সেখানকার বাজারগুলোতে ইলিশের দাম তুলনামূলক কম। তারপরও প্রতি বছরের মতো সে দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের দাবিতে ইলিশ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ইলিশ বিশেষজ্ঞ আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার ইলিশের দাম সত্যিই অস্বাভাবিক। এ দেশে ইলিশের প্রাচুর্য আছে। তারপরও এর এত দাম মেনে নেওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত না নেওয়া ভালো ছিল বলে আমার মনে হয়। ইলিশের ক্ষেত্রে কথা ছিল, দেশের চাহিদা মেটানোর পরে রপ্তানি বা অন্য কিছু। কিন্তু এবার কোনো অবস্থায় দাম কমানো যাচ্ছে না, মাছও এখনো পর্যাপ্ত নয়।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘ইলিশের পিক সিজন শুরু হয়েছে, যা সেপ্টেম্বর-নভেম্বর। এখন একটা পূর্ণিমা হচ্ছে। কিছু ইলিশ আসবে। তবে এবার কতটা ভালো উৎপাদন হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ। কারণ আবহাওয়া পরিবর্তন, দূষণ, নদীর নাব্য কমে যাওয়া ও নদীতে মাছের পর্যাপ্ত খাবার না থাকার প্রভাবে ইলিশ কমছে।’
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব। সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই। এত দামে আমরা নিজেরাই খেতে পারছি না। এর মধ্যে রপ্তানি করলে ব্যবসায়ীরা আরও দাম বাড়িয়ে দেবে। সরকারের উচিত ছিল সাধারণ মানুষের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।’
দেশের বাজারের চেয়ে কম দামে ভারতে যাবে ইলিশ
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার প্রতি কেজি ইলিশের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ১২ দশমিক ৫ মার্কিন ডলার বা ১৫২৫ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে) নির্ধারণ করেছে। তবে এ দামে ঢাকার বাজারে এক কেজি সাইজের একটি ইলিশ পাওয়া যায় না।
সোমবার বাজার ঘুরে দেখা যায়, এক কেজি সাইজের ইলিশের দাম আড়াই হাজার টাকা। তার চেয়ে বড় হলে তিন হাজার টাকারও বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতারা। সুপারশপগুলোতেও এক কেজি সাইজের ইলিশের কেজি কম-বেশি ২৪শ-২৮শ টাকা।
খুচরা বাজারেও সাগর ও নদীর মাছভেদে কেজি সাইজের কম বা ৮শ গ্রাম হলে ১৮শ, ৬শ গ্রামের কাছাকাছি ১৪শ-১৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর ৪শ গ্রাম বা তার চেয়ে কম ওজনের ইলিশের কেজিও হাজার টাকার ওপরে।
ফলে ইলিশের কেজিপ্রতি গড় দাম ধরা হলে সেটা প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি হবে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এবার ইলিশের দাম ৯শ থেকে ২২শ টাকা, যা গত বছর ছিল ৮শ থেকে ১৬শ টাকার মধ্যে।
এদিকে ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ভরা মৌসুমে ২০১৪ সালে ৫০০-১০০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের গড় দাম ছিল ৫০৫ টাকা, যা এখন বাজারে কয়েকগুণ বেশি।
এবার উৎপাদন কমবে?
দেশে এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে ইলিশ আহরণ বাড়ার পর গত বছর থেকে কমেছে। সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তর প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ ৪২ হাজার টন কমেছে। এ বছরও শুরু থেকে ইলিশ আহরণ কম।
মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয় পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন। গত অর্থবছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টন। সে হিসাবে ইলিশ আহরণ ৪২ হাজার টন কম হয়েছে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো এবারও আহরণ কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৯৮ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ পাঁচ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়। যদিও সাম্প্রতিককালে ইলিশ উৎপাদন কমেছে। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নদী ও সাগরে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছর ছিল পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষ হয়নি। হিসাব এখনো তৈরি হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ অর্থবছরেও উৎপাদন কমবে।
যে কারণে রপ্তানিও গতবারের অর্ধেক
ইলিশ রপ্তানির অনুমতি নেতিবাচকভাবে দেখা হলেও একটি সুখকর বিষয় হচ্ছে গত বছরের চেয়ে এবার রপ্তানির পরিমাণ কমানো হয়েছে। গত বছর (২০২৪) দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে শেষ পর্যন্ত দুই হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়। এবার এর অর্ধেক ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হলো। গতবার সব মিলিয়ে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে।
অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ইলিশ রপ্তানি না করা, অনুমতি কোনোভাবেই হস্তান্তর না করা এবং অনুমোদিত রপ্তানিকারক ছাড়া ঠিকায় (সাব-কন্ট্রাক্ট) রপ্তানি না করার শর্তও থাকছে। বলা হয়েছে, সরকার যে কোনো সময় রপ্তানি বন্ধ করতে পারবে। সব সময়ই এসব শর্ত থাকে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দেশে দাম বেশি ও উৎপাদন কমার আশঙ্কায় এবার অনুমোদিত পরিমাণ কমানো হয়েছে। রপ্তানি বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি রয়েছে।
পাঁচ বছর ধরে ভারতে যাচ্ছে ইলিশ
২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতীয় রপ্তানি নীতিতে (২০১৫-১৮) ইলিশ মাছ শর্তসাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় রাখা হয়। তবে ইলিশ রপ্তানির প্রথম অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। সেবার ইলিশের তিনটি চালান ভারতে পাঠানো হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয় এক হাজার ৬৯৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৩৯১ টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন।
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএমএ