দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীতে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি বিমানবন্দর। আট দশক পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী সেই বিমানবন্দরটি এখন কোলাহলশূন্য পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
বিমানবন্দরটির দক্ষিণে রয়েছে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণাগার ও কৃষি ইনস্টিটিউট এবং হর্টিকালচার সেন্টার। দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হালকা ও ভারী ফায়ারিং রেঞ্জ। উত্তরে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি আবাদের জন্য ৩০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে পানি নিষ্কাশনের প্যারালাল খাল (আনিস খাল)।
জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জঙ্গি বিমানগুলোতে জ্বালানি তেল ভরার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী সেই সময় হাটহাজারীতে বিমানবন্দরটি স্থাপন করেছিল। বিমানবন্দরটির জন্য তখনকার সদর ইউনিয়ন পরিষদের আলমপুর গ্রাম ও এর আশপাশের ৩৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
বিমানবন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ভবন, সিগন্যাল হাউস, রানওয়ে, জ্বালানি তেলের জন্য রিজার্ভার নির্মাণ করা হয়েছিল। তখনকার দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার দিনে এ রকম একটি বিমানবন্দর নির্মিত হয়েছিল শুধুই যুদ্ধের প্রয়োজনে।
বিমানবন্দরটির চারদিকে খোলা বিলের মধ্যে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলোতে দৃষ্টি আটকে যায়। বিশেষ করে ক্ষয়ে যাওয়া কংক্রিট আর সিমেন্টের তৈরি রানওয়ে, সিগন্যাল ঘর, যুদ্ধবিমানের তেলের আঁধারের স্মৃতিচিহ্নগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে আশপাশে গড়ে ওঠা ঘরবাড়ি। রক্ষণাবেক্ষণ না করলে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটির শেষ চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না।
আদর্শ গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ মো. ইদ্রিস মিয়া বলেন, ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য যাই হোক, হাটহাজারীর এই বিমানবন্দর বিশ্ব ইতিহাসের একটি অংশ। অথচ এখানকার তরুণরা এটি সম্পর্কে কিছুই জানে না। এমনকি ঐতিহাসিক স্থাপনাটির আশপাশে যারা এসে বসবাস শুরু করেছেন, তারাও জানেন না এটা কী ছিল। তবে এলাকার পুরোনো বাসিন্দা, প্রবীণরা বলতে পারেন বিলুপ্ত বিমানবন্দরের ইতিকথা।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবিমানগুলোতে তেল ফুরিয়ে গেলে এখানে তেল নিতে আসত। ব্রিটিশ সরকার এই বিমানবন্দরের জন্য অনেক ফসলি জমি অধিগ্রহণ করেছিল। এর বিনিময়ে তারা খাজনা দিত। ব্রিটিশরা বিদায় নেওয়ার পর জমিগুলো পুরোনো মালিকরা যার যার জায়গা নিজেরাই নিয়ে নেন।
হাটহাজারী সরকারি কলেজের ছাত্র স্থানীয় আব্দুল কাইয়ুম আরাফাত বলেন, আমি বুঝতে শেখার পর থেকে দেখছি বিলের মাঝখানে একটা প্লাস্টারবিহীন দোতলা ঘর আছে। আমাদের মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি, এখানে নাকি ব্রিটিশ আমলে বিমানবন্দর ছিল। এতটুকুই জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষয়ে কিছুই জানি না।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টির পানি ও ধুলাবালির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শনটি। আট দশক আগে নির্মিত স্থাপনাগুলোর জরাজীর্ণ দশা। রানওয়ের কিছু অংশ দেখা যায়। তেলের রিজার্ভারের কিছু অংশবিশেষ আছে, দেখলে মনে হয় কালভার্ট। প্রশাসনিক ভবন ও সিগন্যাল ঘর আগাছায় পরিপূর্ণ।
মিরেরহাট এলাকার বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর শিপক নাথ কালবেলাকে বলেন, ১৯৪৫ সালের পর থেকে বিমানবন্দরটি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। যেন বিলুপ্ত বিমানবন্দরের সাক্ষী। ক্ষয়ের স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে এগুলো যেন নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করে যাচ্ছে। বিমানবন্দরটির ৫০০-৬০০ গজের মধ্যেই পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ছড়াগুলো বর্ষায় জেগে ওঠে। তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়।
তিনি আরও বলেন, পাহাড় আর সমতলের মেলবন্ধনের সঙ্গে এর গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন মিলিয়ে এলাকাটি পর্যটন এলাকার মর্যাদা পেতে পারে। ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি জেলা দুগ্ধ খামার, নির্মাণাধীন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মবেজড ক্যাম্পাস, কৃষি ইনস্টিটিউট, হর্টিকালচার সেন্টারও পর্যটকদের কাছে টানবে নিঃসন্দেহে।