নিত্যপণ্যের বাজারে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে দ্রব্যমূল্য কমানোকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। নিচ্ছে দফায় দফায় বিভিন্ন পদক্ষেপ। টাস্কফোর্স গঠন করে জোরদার করেছে নজরদার-তদারকি ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি আমদানি পর্যায়ে নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানোসহ নানা পদক্ষেপও নিয়েছে। তদুপরি কোনো কোনো বাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঝটিকা অভিযানও পরিচালনা করছে। মোট কথা, বাজারের দুঃসহ অবস্থা থেকে ক্রেতা-ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে যতরকম উদ্যোগ নেওয়া যায় তার সবই নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ধরনের উদ্যোগের ফলে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আসবে-এমনটি আশা করা যায় নিঃসন্দেহে।
অতীতে দেখা গেছে— পণ্যের দাম বৃদ্ধি যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো এবং বাজার তদারকি জোরদার করার মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে এর সবগুলো পন্থা প্রয়োগ করছে নতুন সরকার। তবুও দাম বাড়ছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতেই অতি প্রয়োজনীয় তিন পণ্য— আলু, পেঁয়াজ এবং ডিম আমদানির ওপর সব ধরনের শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গত কিছুদিন আগেও নাগালের বাইরে থাকা ডিমের দাম এখন স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে ফিরেছে।
বাজারে সংকট শুরুর আগেই নিতে হবে ব্যবস্থা। তাছাড়া, রাস্তায় অবৈধ টোল ও চাঁদাবাজি বন্ধে আইনগতভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও শোনা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। তবে তা আবার শুরু হয় কি না,সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
অক্টোবরে গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এ সময় দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশ হয়েছে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ১০.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর অক্টোবরে যে খাদ্যপণ্যের মূল্য ছিল ১০০ টাকা, এবার অক্টোবরে তা ভোক্তাদের ক্রয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৬৬ পয়সায়। এই খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব রেখেছে চাল, সবজি, ডিম,আলু, মুরগি ও পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। সিন্ডিকেট করে অসাধু ব্যবসায়ীদের হীন প্রচেষ্টা এবং সরবরাহ সংকটের কারণও দাম বৃদ্ধির আরেক কারণ। এসব হিসাব-নিকাশ বলছে, নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জই হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ।
তবে শুধু বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ভাবলেই চলবে না। পাশাপাশি রমজান মাসকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য কমানো এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে এখন থেকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে। কারণ, সাধারণ সময়ে কিছু পণ্যের যে চাহিদা থাকে রমজানে সেটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। বেশকিছু পণ্যের দ্বিগুণেরও বেশি চাহিদা থাকে। যেমন সারা বছরে খেজুরের যে চাহিদা থাকে তার অর্ধেকটাই লাগে রমজানে। আবার ডাল, তেল, চিনি ও ছোলার চাহিদা বর্তমানের চেয়ে রমজানে অনেক বেশিই থাকে। রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়া এসব অনেক পণ্যের এলসি খুলে আমদানি করতে বেশ সময় লেগে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাসও লাগে। সরকারের কথাবার্তাতে মনে হচ্ছে, তারা এই বিষয়টিকে এখন থেকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।’ অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বিগত শাসনামল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আর্থিক, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতের সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।’
তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যার সমাধান করতে হলে স্বল্পমেয়াদির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির পথ সচল রাখতে হবে, আয় বাড়াতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে তাদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মোকাবিলা করছে, তা থেকেও শিক্ষা নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এর পাশাপাশি সিন্ডিকেট দমনে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে আইনের শক্ত প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সিন্ডিকেট দমনে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়। এর পাশাপাশি, ২০১৮ সালে প্রণীত হয় কৃষি বিপণন আইন ২০১৮। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই আইনগুলোর কোন প্রয়োগ নেই।
যেমন মাছ-মাংস, সবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে থাকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তবে এদের মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা থাকলেও কেউ যদি না মানে তবে তাদের কোনো ধরনের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা নেই। কেবল কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, কেবল অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এই সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তখন দ্বারস্থ হতে হয় প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের। কিন্তু আমাদের বর্তমান বিচারিক ব্যবস্থায় এই প্রক্রিয়াটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে না।
তাছাড়া যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, ভরা মৌসুমে সেসব পণ্যের বাজারেও তৈরি করা হয় অস্থিরতা। যেমন আমাদের দেশে চালের ঘাটতি নেই। চাহিদার চেয়ে ধানের উৎপাদন বেশি। ফলে ইচ্ছে করলে আমরা কিছু চাল রপ্তানিও করতে পারি। অথচ গত কয়েক বছর ধরে চালের দাম বেড়েই চলেছে। সরকার নানা কৌশল অবলম্বন করলেও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা করতে পারেনি। সম্প্রতি তো আরও বেড়েছে। এর কারণ হচ্ছে, মিল মালিকরা বেশি দামে ধান কেনার অজুহাত উপস্থাপন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বেশি দামে চাল বিক্রির পরও তারা কৃষককে ধানের ন্যায্যমূল্য দিচ্ছেন না। অর্থাৎ মূল্য কোথায় বাড়ছে এবং কারা এসব নিয়ন্ত্রণ করছে সেই জায়গাগুলো কিন্তু অজানা নয়। এই জায়গাগুলোতে এখনই হাত দিতে হবে।
তাই দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়াকে বাগে আনতে আমদানি করা পণ্যের সিন্ডিকেট শুরুতেই ভাঙতে হবে। ভাঙতে হবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের সিন্ডিকেটও। আর এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়া বাজার তদারকির সাথে যুক্ত বেশিরভাগ সংস্থাই মাঠে মূলত অকার্যকর। এই সংস্থাগুলোর কাজের গতি বাড়াতে হবে।
এসবের পাশাপাশি, বাজারে সংকট শুরুর আগেই নিতে হবে ব্যবস্থা। তাছাড়া, রাস্তায় অবৈধ টোল ও চাঁদাবাজি বন্ধে আইনগতভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও শোনা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। তবে তা আবার শুরু হয় কি না,সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম