ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে সেনাবাহিনী
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলস কাজ করে চলেছে বলে জানিয়েছেন ৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং সাভার সেনানিবাসের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. মঈন খান।
তিনি বলেন, যেখানেই সমস্যা হয়েছে, ৯ পদাতিক ডিভিশন সেখানেই ছুটে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষা করে যাব। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করে যাব, এই নিশ্চয়তা আপনাদের দিতে পারি।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে ‘স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ১৯০তম জন্মতিথি এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাংলাদেশে আগমনের ১২৫তম বর্ষ উৎসব উপলক্ষে গত শনিবার থেকে শুরু হয়েছে সাতদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। আগামী শুক্রবার এ আয়োজন সমাপ্ত হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে রয়েছে উল্লেখ করে মেজর জেনারেল মঈন বলেন, পট পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়ার পর সেনাপ্রধান আমাকে দুটি বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে বলেছিলেন–বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন কোনোভাবেই বিপর্যস্ত না হয়। শিল্প কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সুন্দরভাবে কাজ করতে পারে সেজন্য তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। সেনাপ্রধান আমাকে বলেছিলেন, অর্থনীতি যদি ক্ষতিগ্রস্ত ও পঙ্গু হয়ে যায় তাহলে দেশ টিকবে না। তখন আমরা ৯ ডিভিশন থেকে একটা টাস্কফোর্স গঠন করে শিল্প কলকারখানার নিরাপত্তা বিধান করে আসছি।
মেজর জেনারেল মঈন আরও বলেন, সেনাপ্রধান আমাকে আরেকটি বিষয় বলেছিলেন–যেকোনো মূল্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে হবে। তারা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারা যদি পিছিয়ে পড়ে, তারা যদি আমাদের সঙ্গে একতাবদ্ধ না থাকে তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা থাকবে না। বাংলাদেশ যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছে সেটা অর্জিত হবে না। সেনাবাহিনী প্রধান ওই কথা বলার পর আমরা সারাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ৯ ডিভিশন থেকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করি। এ কাজে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আল আমিনকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেখানেই সমস্যা হয়েছে, ৯ পদাতিক ডিভিশন সেখানেই ছুটে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা রক্ষা করে যাব।
আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, সবার অধিকার সমান– এমন মন্তব্য করে মঈন খান বলেন, আমরা হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে এই দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাব। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানে কোনো ভেদাভেদ নেই, পার্থক্য নেই–এ বিশ্বাস আমাদের আছে। ছোটবেলা থেকে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এসেছি। আমরা সেই পরিবেশে বড় হয়েছি। আমরা বাংলাদেশকে সেইভাবেই রেখে যেতে চাই। আগামী প্রজন্মের হাতে আমরা দেশকে সেইভাবে দিয়ে যেতে চাই।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভাগীয় প্রতিনিধি সভার প্রসঙ্গ টেনে সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের এই জিওসি বলেন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কথা শুনেছেন। সেনাবাহিনীর সহায়তায় এই কাজটি করা হয়েছে। সেখানে যেসব সমস্যা উঠে এসেছে দ্রুত সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেব। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করবো। এ নিশ্চয়তা আমি আপনাদের দিতে পারি। ভবিষ্যতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরও কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন মেজর জেনারেল মঈন।
বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলেন, অনুষ্ঠানের শুরুতে আমরা এখানে ছাত্রদের একটা মনোমুগ্ধকর কুচকাওয়াজ দেখলাম। দেখে অত্যন্ত ভাল লাগলো এবং আশ্বস্ত হলাম যে, রামকৃষ্ণ মিশন একটা চমৎকার কাজ করছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের জন্য গড়ে তুলছে। এটা একটা অত্যন্ত আশার কথা। এই যে শিক্ষিত, সব দিক দিয়ে মানবিক গুণাবলীতে বিকশিত একটা প্রজন্মের কাছে আমরা দেশটাকে রেখে যেত পারব, এটা সম্ভব হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের এই উদ্যোগের জন্য। এ জন্য আমরা তাদেরকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই।
মেজর জেনারেল মো. মঈন খান আরও বলেন, যে দুজন মহাপুরুষ উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান, তাদেরকে আসলে আমাদের জাতির জন্য বিশেষ প্রয়োজন। তারা যদি আজকে বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমাদের জাতির জন্য আরও মঙ্গল হতো, ভাল হতো। তারা আমাদের শিখিয়েছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। তারা আমাদের আরও শিখিয়েছেন, ‘যত মত তত পথ’, অর্থাৎ পরমত সহিষ্ণু হতে বলেছেন। তারা আমাদের শিখিয়েছেন, আত্মার শান্তির কথা, সমাজের শান্তির কথা, বিশ্বের শান্তির কথা। এই সবকিছুই আজকে আমাদের এই সমাজে, অস্থির পরিস্থিতিতে বিশেষ বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। সুতরাং তাদের দর্শন, তাদের মত ও পথকে আমরা যদি অনুসরণ করতে পারি, আজকে যে অস্থির সময় অতিক্রম করছি, সেটা আমরা অত্যন্ত সহজভাবে অতিক্রম করতে পারব। বাংলাদেশকে একটি সুন্দর, সুখী, সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারব।
আলোচনা সভায় ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ বলেন, স্বামী বিবেকানন্দ বাংলাদেশে এসে একটি বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ দিন ছিলেন। পুরান ঢাকার সেই বাড়িটি এখন উপেক্ষিত। স্বামীজীর স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য সেটি পুনরুদ্ধার করা গেলে তা ভক্তদের জন্য দারুণ ব্যাপার হবে। বিষয়টি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মেজর জেনারেল মো. মঈন খানকে অবহিত করে তার সহায়তাও কামনা করেন তিনি।
ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালন পর্ষদের সভাপতি বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালন পর্ষদের সদস্য প্রবীর কুমার সাহা, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি ও ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালন পর্ষদের সদস্য জয়ন্ত কুমার দেব প্রমুখ।
এর আগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে এসে পৌঁছানোর পর মেজর জেনারেল মঈন খানকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান মিশন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা। পরে তিনি রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট তাপস পালসহ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের মহারাজবৃন্দ।