সবুজ ধানের অন্যতম শত্রু বাদামি গাছফড়িং। এটি কারেন্ট পোকা নামেও পরিচিত। খুব তাড়াতাড়ি বংশ বৃদ্ধি করে। এ পোকার সংখ্যা এত বেড়ে যায়, আক্রান্ত ক্ষেতে বজ্রপাতের মতো হপার বার্নের সৃষ্টি হয়।
আকার-আকৃতি
গায়ের রং বাদামি বা গাঢ় বাদামি। পূর্ণবয়স্ক পোকা লম্বা ও খাটো ধরনের হয়ে থাকে। দেহ খুবই নরম। স্ত্রী পোকার পেট পুরুষ অপেক্ষা বেশ বড়। পূর্ণবয়স্ক পোকা ৩.৫-৫.০ মিলিমিটার লম্বা। স্ত্রী পোকা পুরুষ অপেক্ষা বড়।
জীবনচক্র
বাদামি গাছফড়িংয়ের জীবনচক্রে তিনটি স্তর আছে। স্তরগুলো হচ্ছে- ডিম, বাচ্চা এবং পূর্ণাঙ্গ। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী ফড়িং খোল পাতার ভেতরে গুচ্ছ আকারে ৮-১৬টি ডিম পাড়ে। ৪-৯ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। প্রথম পর্যায়ে বাচ্চা ৫ বার খোলস বদলায়। বাচ্চাগুলোর রং সাদা থাকে। পরে বাদামি রং ধারণ করে। বাচ্চা থেকে খাটো ও লম্বা পাখা-বিশিষ্ট উভয় ধরনের পূর্ণবয়স্ক ফড়িং হতে পারে। সাধারণত ধান পেকে গেলে লম্বা পাখা বিশিষ্ট পূর্ণবয়স্ক ফড়িং দেখা যায়।
পূর্ণবয়স্ক পোকার গায়ের রং বাদামি। আকারে প্রায় ৪ মিলিমিটার। বাচ্চা থেকে পূর্ণবয়স্ক ফড়িংয়ে পরিণত হতে আবহাওয়া ভেদে ১৪-২৬ দিন সময় লাগে। পূর্ণবয়স্ক বাদামি গাছফড়িং প্রায় ৩ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। এর একটি জীবনচক্র শেষ হতে আবহাওয়া ভেদে ২১-৩৩ দিন সময় লাগে। অনুকূল আবহাওয়ায় বছরে ১০-১১ বার বংশ বিস্তার করতে পারে। এক জোড়া (পুরুষ ও স্ত্রী) পোকা থেকে দু’এক মাসের মধ্যে হাজার হাজার পোকা জন্ম নিতে পারে।
অনুকূল পরিবেশ
বেঁচে থাকা ও বংশ বিস্তারের জন্য আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত স্থান খুবই প্রয়োজন। যেসব জমি সব সময় ভেজা থাকে বা কিছু পানি জমে থাকে; সেসব জমিতে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়। ঘন করে চারা রোপণ করলে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে পোকার আক্রমণ বেশি হতে পারে। জমি থেকে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার না করলে এবং সারি করে চারা রোপণ না করলে পোকার আক্রমণ বেশি হতে পারে। ১২-৩১ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এ পোকার বংশ বিস্তার বেশি হয়। এরা আলো-বাতাস পছন্দ করে না। ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গার কাছাকাছি এরা বাস করে। পোকার বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক উভয় অবস্থায়ই ধান গাছের গোড়ায় বসে গাছের রস চুষে খায়। ফলে ধান গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পোকার সংখ্যা বেশি হলে আক্রান্ত ফসলে বজ্রপাতে পোড়ার মতো (হপার বার্ন) অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
আক্রমণের লক্ষণ
বাদামি গাছফড়িং বাংলাদেশে ধান ফসলের জন্য বর্তমানে একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর পোকা। বোরো, আউশ এবং রোপা আমনের উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতেই এ পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় ধান গাছের গোড়ায় কাণ্ড এবং পাতার খোল থেকে রস শুষে খায়। একসাথে অনেকগুলো পোকা রস শুষে খাওয়ার ফলে প্রথমে হলদে ও পরে শুকিয়ে মারা যায়। দূর থেকে পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়। এ ধরনের ক্ষতিকে ইংরেজিতে ‘হপার-বার্ন’ বা ফড়িং পোড়া বলা হয়। ধানে শীষ আসার সময় বা তার আগে হপার বার্ন হলে কোনো ফলনই পাওয়া যায় না। তবে ধানের দানা শক্ত হওয়ার পর হপার-বার্ন হলে ২০-৪০% ক্ষতি হয়। সাধারণত ধানের কুশি গজানো অবস্থা থেকে ধান পাকা অবস্থা পর্যন্ত আক্রমণ করতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে কাইচ থোড় অবস্থা থেকে দুধ অবস্থা পর্যন্ত। ধান গাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে।
জৈব ব্যবস্থাপনা
১. বাদামি গাছফড়িং সহনশীল জাতের চাষ করা।
২. ধানের চারাভেদে দুই সারির মাঝে ১০-১২ ইঞ্চি ফাঁকা রাখুন এবং ৮-১০ ইঞ্চি দূরে দূরে চারা লাগান।
৩. ১০ সারি পর পর ১ সারি বাদ রেখে ল্যাগ পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এতে ধান ক্ষেতে প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশ করবে। ফলে বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ কম হবে। তবে ফলনে কোনো কমতি হবে না।
৪. প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ধানক্ষেত পর্যবেক্ষণ ও জরিপ করে পোকার উপস্থিতি যাচাই করুন।
৫. বাদামি গাছ ফড়িংয়ের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ধানক্ষেতের পাশে সন্ধ্যার পর ৩ ঘণ্টা আলোক ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
৬. সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। ইউরিয়া সার বেশি মাত্রায় ব্যবহার করলে চারা বেশি সবুজ ও রসালো হয়। ফলে পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। তাই এলসিসি ব্যবহার করে পরিমিত মাত্রায় ইউরিয়া সার ২-৩ বার ব্যবহার করুন।
৭. আক্রান্ত ক্ষেতের আগাছা, মরা পাতা, খোল ইত্যাদি পরিষ্কার করে ক্ষেতে বেশি আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন।
৮. ধানের জমিতে সব সময় পানি আটকে না রেখে মাঝে মাঝে জমি শুকিয়ে ফেলুন। এতে পোকার আক্রমণ ও বংশ বৃদ্ধি কমে যাবে।
৯. এ পোকার বিকল্প পোষক আঙুলি ঘাস ধ্বংস করতে হবে।
১০. ধানক্ষেতে বাদামি গাছফড়িংয়ের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলে ২ হাত পর পর ফাঁড়ি বা বিলি করে দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দিন।
১১. স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন ধানের জাতের চাষ করতে হবে।
১২. বাদামি গাছফড়িংয়ের আক্রমণ হলে গ্রামের সবাই মিলে এ পোকা দমনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৩. ক্ষেতে ধান শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে দেরি না করে কেটে ফেলতে হবে।
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা
উপরের পদ্ধতিতে বাদামি গাছফড়িং দমন করা সম্ভব না হলে তখন শেষ ব্যবস্থা হিসেবে পাইমেট্রোজিন+ডিনটিফুরনি (ইবু) বা নিতেনপাইরাম (সেগা) জাতীয় কীটনাশক (যেমন- ইবু বা সেগা ইত্যাদি) আক্রান্ত গাছের গোড়ায় সঠিক মাত্রায় স্প্রে করুন। নিকটস্থ কৃষি অফিসের পরামর্শ নিন।
এসইউ/জিকেএস