রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক পিএলসি গত কয়েক বছরে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, বড় অঙ্কের অনাদায়ী ঋণ ও তারল্য সংকটসহ নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে। একসময় এ ব্যাংক ঘিরে তৈরি হয়েছিল গ্রাহকদের আস্থাহীনতা।
এমন এক কঠিন সময়ে ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নেন মো. মজিবর রহমান। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শুরু করেন পুনর্গঠনের কার্যক্রম। তারল্য সংকট, আমানত, রিকভারি, প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপন।
জাগো নিউজ: আপনি যখন জনতা ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন ব্যাংকের অবস্থা কেমন ছিল?
মো. মজিবর রহমান: আমরা একটি অত্যন্ত কঠিন সময়ের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করি। প্রতিদিন ২২ হাজার কোটি টাকার মতো কলমানি ধার করতে হচ্ছিল। তারল্য সংকট ছিল প্রবল। আমানতকারীদের মধ্যে অনাস্থা ছিল, সিআরআর ও এসএলআরে ঘাটতির আশঙ্কা করছিলাম। সেই সময়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সহায়তা পাইনি। তবে আমরা থেমে থাকিনি।
আমরা রেমিট্যান্স বাড়াতে সক্ষম হই, ফলে ২২শ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে এসেছে
জাগো নিউজ: এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব হলো?
মো. মজিবর রহমান: আমরা বিভিন্ন ধরনের নতুন প্রোডাক্ট ও সেবা চালু করেছি। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে এনগেজ করেছি। অফিসার থেকে ডিজিএম পর্যন্ত সবাইকে ব্যক্তিগত টার্গেট দেওয়া হয়েছে এবং সেই টার্গেট অর্জনে প্রমোশনের সুবিধার নির্দেশনা দিয়েছি। গণমাধ্যমে প্রোডাক্ট প্রচার করেছি এবং গ্রাহকদের আস্থা ধরে রাখতে পেরেছি। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের আমানত এক লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়।
আরও পড়ুন
গ্রাহক আস্থায় এনআরবিসি ব্যাংকের আমানত বাড়ছে
শিগগির অগ্রণী ব্যাংক খেলাপিমুক্ত হয়ে আগের মর্যাদায় ফিরবে
এবি ব্যাংককে শক্তিশালী-বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে চাই
জাগো নিউজ: বর্তমানে ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি কেমন?
মো. মজিবর রহমান: আগে যেখানে প্রতিদিন ২২ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হতো, এখন সেই পরিমাণ নেমে এসেছে ১০ থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটিতে। এছাড়া এখন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের একটি চেকও বাউন্স হয়নি– হোক সেটা হাজার টাকা বা হাজার কোটি টাকার।
আমরা এখন আর বড় প্রকল্পে যাচ্ছি না। বরং সিএসএমই-এসএমই খাতে মনোযোগ দিচ্ছি। এতে আঞ্চলিক অর্থায়ন বাড়বে এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে। স্থানীয় টাকা স্থানীয় উন্নয়নে কাজে লাগবে
জাগো নিউজ: বিদেশি লেনদেন ও রেমিট্যান্স পরিস্থিতি কেমন ছিল?
মো. মজিবর রহমান: দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখি বহু ফরেন বিল পেমেন্ট বকেয়া ছিল, অনেক প্রতিষ্ঠান উকিল নোটিশ দিয়েছিল। আমরা রেমিট্যান্স বাড়াতে সক্ষম হই, ফলে ২২শ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে এসেছে।
জাগো নিউজ: মানবসম্পদ উন্নয়নে আপনি কোন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?
মো. মজিবর রহমান: ২০২১-২২ সালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং দেওয়া হয়নি, দীর্ঘদিন সেশন জট ছিল। আমরা প্রতি শনিবার ট্রেনিং অন্তর্ভুক্ত করেছি, আঞ্চলিক স্টাফ কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়িয়েছি এবং একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করছি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে পুরো জট কাটিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারবো।
জাগো নিউজ: ঋণ পুনরুদ্ধারে কী ধরনের অগ্রগতি হয়েছে?
মো. মজিবর রহমান: আমরা রিকভারি টাস্কফোর্স গঠন করেছি, আঞ্চলিক পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। গত বছরের তুলনায় জুলাই পর্যন্ত বেশি পরিমাণ অর্থ আদায় হয়েছে– প্রায় ৮৮২ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত রিকভারি হয়েছে ৪৬০ কোটি, যেখানে গত বছর পুরো বছরে ছিল ৪২২ কোটি টাকা। দ্বিগুণ রিকভারি হয়েছে বলা যায়।
জাগো নিউজ: বড় ঋণের বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী?
মো. মজিবর রহমান: জনতা ব্যাংকের বড় বড় ঋণ খুব অল্প কিছু শাখার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলেই এ সংকট তৈরি হয়েছিল। আমরা এখন আর বড় প্রকল্পে যাচ্ছি না। বরং সিএসএমই-এসএমই খাতে মনোযোগ দিচ্ছি। এতে আঞ্চলিক অর্থায়ন বাড়বে এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে। স্থানীয় টাকা স্থানীয় উন্নয়নে কাজে লাগবে।
ভুল বারবার করলে চলবে না। আমরা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। অর্থ উপদেষ্টার নির্দেশে সতর্ক রয়েছি যেন নতুন করে কোনো দুর্বৃত্তায়ন না হয়
জাগো নিউজ: ট্রেজারি ফাংশন ও বিনিয়োগ নিয়ে কিছু বলবেন?
মো. মজিবর রহমান: আগে ট্রেজারি ফাংশনে নন-প্র্যাক্টিস ছিল। আমরা সেখানে নিরাপদ বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়েছি এবং কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছি। আমাদের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অত্যন্ত আন্তরিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এফআইডির সচিব– সবাই আমাদের পাশে আছেন। সেই পরামর্শগুলো কাজে লাগাচ্ছি।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
মো. মজিবর রহমান: ভুল বারবার করলে চলবে না। আমরা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি। অর্থ উপদেষ্টার নির্দেশে সতর্ক রয়েছি যেন নতুন করে কোনো দুর্বৃত্তায়ন না হয়। সিএসএমই-এসএমই ও কৃষি খাতে অর্থায়ন বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করছি যে, দুর্বৃত্তায়নের জায়গা যেন কমে আসে। আমাদের কৌশল এখন স্থানীয় উন্নয়ন, দক্ষ জনবল ও টেকসই ব্যাংকিং।
জাগো নিউজ: আপনি কীভাবে ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী?
মো. মজিবর রহমান: জনতা ব্যাংক একসময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সামনে আরও ভালো করার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা আছে। গণমাধ্যমসহ সবার সহযোগিতা পেলে আমরা অবশ্যই একটি আদর্শ ও লাভজনক রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে পরিণত হতে পারবো– এটাই আমাদের বিশ্বাস।
ইএআর/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম