দেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ নষ্ট ও আমদানিনির্ভরতা কমাতে আধুনিক এয়ারফ্লো পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটি)। এক বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে রাজবাড়ীতে ৬০০ জনসহ দেশের ১৬টি জেলায় তিন হাজার ৭০০ জন পেঁয়াজচাষি এই সুবিধা পাবেন।
এয়ারফ্লো পদ্ধতিতে ১০ ফুট বাই ১০ ফুট এবং ৬ ফুট উচ্চতার ঘর তৈরি করতে হবে। তারপর এয়ারফ্লো মেশিন স্থাপন করে ১-৯ মাস পর্যন্ত আড়াই থেকে তিনশ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ নষ্ট হয় না। তবে পেঁয়াজের ওজন এক থেকে দুই শতাংশ কমে বলে দাবি প্রকল্প পরিচালক ও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের। বিশেষ এই ঘর তৈরি ও মেশিন কেনায় খরচ ধরা হয়েছে মাত্র ২৭ হাজার টাকা।
প্রকল্পের আওতার প্রথম পর্যায়ে রাজবাড়ীতে ১২০ কৃষককে নিয়ে শেষ হয়েছে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণে আধুনিক পেঁয়াজ সংরক্ষণ মেশিনের সুবিধা বিষয়ে ধারণাসহ হাতে-কলমে শেখানো হয় মেশিনের ব্যবহার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মসলাজাতীয় ফসল পেঁয়াজ আবাদের সমৃদ্ধ জেলা রাজবাড়ী। এ জেলায় সারাদেশের প্রায় ১৬ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এবং দেশের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থান রাজবাড়ী। ফলে জেলার উৎপাদিত পেঁয়াজ সারাদেশের চাহিদার বৃহৎ একটি অংশ পূরণ করে। জেলার পাঁচ উপজেলায় কমবেশি পেঁয়াজের আবাদ হলেও কালুখালী, বালিয়াকান্দি ও পাংশায় আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবছর জেলায় ৩৬ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। পাঁচ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের স্থানে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ আবাদ-ফলন দুটোও বেড়েছে।
আরও পড়ুন:
পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কতদূর?
পেঁয়াজের দামে পুঁজিও টিকছে না চাষিদের
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষকরা বলছেন, প্রতিবছর সংরক্ষণের অভাবে অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হয়। ফলে লোকসান গুনতে হয় তাদের। তবে এয়ারফ্লো মেশিনের বিষয়ে প্রশিক্ষণের পর বুঝতে পারছেন, এই পদ্ধতি পেঁয়াজ রাখলে নষ্ট হবে না।
বাচ্চু খান নামের একজন কৃষক বলেন, ‘আগে ঘরের চাংয়ের ওপরে পেঁয়াজ রাখতাম। সেখানে এক মণে প্রায় ১০-১৫ কেজি নষ্ট হতো। এখন এই মেশিনগুলো পেলে আমাদের জন্য খুব ভালো হবে। আমাদের এলাকায় বেশ কিছু কৃষক এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ রেখে সুবিধা পেয়েছেন। পেঁয়াজ পচে না। কিছু নষ্ট হলেও সেটি শুকিয়ে যায়। এই পদ্ধতি অনেক ভালো।’
রাজবাড়ী পাংশার মেসার্স হোসেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হোসেন আলী বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে একটি প্রশিক্ষণে গিয়ে আমি পেঁয়াজ সংক্ষরণের এয়ারফ্লো মেশিনের বিষয়ে ধারণা পাই। এরপর থেকে আমি আমার ওয়ার্কশপে এই মেশিন তৈরি করতে থাকি। এখন পর্যন্ত হাজারের বেশি মেশিন তৈরি করেছি। গুণগতমান ভালো হওয়ায় অনেকে আমার ওয়ার্কশপ থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন।’
কথা হয় প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৯ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। সেখান থেকে প্রায় সাত লাখ টন পচে নষ্ট হয় এবং বিদেশ থেকে এই পরিমাণ পেঁয়াজ আবার আমদানি করতে হয়। আবার মাচা পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে গেলে ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়। পরীক্ষা করে দেখেছি, এয়ারফ্লো পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারলে মাত্র ২-৩ শতাংশ পেঁয়াজের ওজন কমবে কিন্তু কোনো পেঁয়াজ নষ্ট হয় না। এই পদ্ধতি সফল হলে আমাদের বাইরের দেশ থেকে আর পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না।’
১০ ফুট বাই ১০ ফুট এবং ৬ ফুট উচ্চতার ঘরে আধুনিক এই এয়ারফ্লো মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে আড়াইশ থেকে তিনশ মণ পেঁয়াজ ৯ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতিটি মেশিন ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে। এই প্রকল্প সফল হলে আগামীতে সারাদেশে আরও বড় পরিসরে প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রথম পর্যায়ে রাজবাড়ীতে ৬০০ জনসহ দেশের ১৬টি জেলায় তিন হাজার ৭০০ জন এই প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ শেষে পেঁয়াজ সংরক্ষণ (এয়ারফ্লো) মেশিন পাবেন। প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি কৃষকদের ব্যাংকের হিসাব নম্বরে মেশিন ক্রয় ও ঘর তৈরির জন্য ২৭ হাজার টাকা দেওয়া হবে। সেই টাকা দিয়ে তারা পছন্দমতো কোম্পানির কাছ থেকে এই মেশিন কিনতে পারবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে কৃষকরা স্বনির্ভর হবেন।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এয়ারফ্লো পদ্ধতি অত্যন্ত আধুনিক এবং একে ‘পেঁয়াজের এসি ঘর’ বলা হয়। অনেক চিন্তা- ভাবনা করে এই পদ্ধতিতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের বলা হচ্ছে। অত্যন্ত অল্প খরচে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষকরা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারবেন।
রুবেলুর রহমান/এসআর/জেআইএম