লেখাটা শুরু করেছিলাম রাজশাহীগামী বাসে যাত্রীদের সামনে একজন নারীর ধর্ষণের ঘটনা দিয়ে। কিন্তু লিখতে লিখতে খবর পেলাম শিশু পূজার ধর্ষক, যে একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি, সে জামিন পেয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামি কীভাবে জামিনে বের হয়ে আসে?
২০১৬ সালে পাঁচ বছরের পূজার যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে, সারা শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা ও বুকে কামড় দিয়ে এক ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করেছিল। এই নিপীড়নের ফলে শিশুটির দুটি মূত্রথলি কাটা পড়েছে এবং সবসময় তার ব্লাডার দিয়ে প্রস্রাব ঝরে।
এই ধর্ষককে বিচারের আওতায় আনতে পাঁচ-ছয়টি সংগঠন জোরালোভাবে কাজ করেছে। মিডিয়াও সহযোগিতা করেছিল। অসংখ্য মানুষ পূজার চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছিলেন। সবার চেষ্টার ফলে ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। খবর হচ্ছে সম্প্রতি সে জামিন পেয়েছে। দোষী সাব্যস্ত একজন ধর্ষককে জামিন দেওয়ার মাধ্যমে কী প্রমাণিত হলো? এই ধর্ষক যে আবার পূজার ওপরে হামলা চালাবে না এর কোনো গ্যারান্টি আছে কি?
যাক ফিরে আসি আগের টপিকসে ‘চিৎকারের আওয়াজ পাচ্ছিলাম, কিছুই করার ছিল না’- বাসে ডাকাতি ও ‘ধর্ষণ’ বিষয়ে যাত্রীরা যা বলেছেন। একবারও ভেবে দেখেছেন কি যৌন হয়রানির শিকার হওয়া এই মেয়েটি হতে পারতো আপনার-আমার সন্তান, স্ত্রী বা বোন। ওই জায়গায় আমাদের পরিবারের যে কোনো নারী সদস্য থাকতে পারতেন। যে দুটি মেয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা কি কখনো ভেবেছিলেন গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই এক বাসভর্তি মানুষের সামনে তারা নিগৃহীত হবেন? কেউ তাদের বাঁচাতে আসবেন না? এ দৃশ্য সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানিয়েছে। এই ট্রমা তাদের ও তাদের পরিবারকে সারাজীবন বহন করে যেতে হবে। মেয়ে দুটির এই ক্ষতি কালে পূরণ হওয়ার নয়। আর কখনো তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
আমরা ভেবেছিলাম রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ধর্ষক ও দুর্বৃত্তরা মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং তারা রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করেছে। এখন দেখছি সময়ের ও নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও নারীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। নারীর চিৎকার আজও কেউ শুনতে পারছে না।
ঢাকা-রাজশাহী রুটে মধ্যরাতে ডাকাতির শিকার হওয়া বাসটি প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতদের দখলে ছিল। এ সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে অভিযোগ করেন বাসটিতে থাকা যাত্রীরা। যাত্রীরা পুলিশ ও সাংবাদিককে বলেন, ওরা বলছিল, ‘চোখ বন্ধ কইরা থাকবি। তাকাইলে কানা করে দিবো,’ ৭৩ বছর বয়স্ক গুড় ব্যবসায়ী বলেছেন, ওই রাতে মা-বোনের ইজ্জতের যে চিল্লাচিল্লি শুনছি আমরা তাতে গাড়ির ভেতরে আমাদের কোনো ভাষা ছিল না।
এ ঘটনায় যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে নাটোর পুলিশ তিনজনকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করলেও, সেখান থেকে তারা জামিনে মুক্তি পেয়েছে। পুলিশ খুবই গাছাড়া ভাবে এই কেসটি হ্যান্ডেল করেছে। ঘটনা কোন থানায় ঘটেছে এ নিয়েই দুই থানা প্রথমে টানাহেঁচড়া করেছে, কেউ দায়িত্ব নিতে চায়নি। শুধু তাই নয়, ওই দুই থানার পুলিশেরই ভাষ্যমতে সেই রাতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এমন তথ্য তারা জানে না।
অতঃপর ঘটনার তিনদিন পর বিভিন্ন সমালোচনার মুখে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ‘শ্লীলতাহানি’র ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। বাসের যাত্রীরা বলছেন ধর্ষণ, যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনিও ধর্ষণের কথা বলছেন কিন্তু পুলিশ বলছে ‘শ্লীলতাহানি’। কেন এমনটা বলছে? কারণ শ্লীলতাহানি বলা হলে মামলা দুর্বল হয়ে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে শনিবার টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান দাবি করেন, বাসে নারী যাত্রীদের ‘প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’ পুলিশ বলেছে, ‘মামলা হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তথ্য প্রযুক্তি ও বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার করে তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। তাদের পাঁচদিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে।’
পুলিশ আসামি ধরার ব্যাপারে যতই নিজেদের কৃতিত্ব প্রচার করুক না কেন, তিনদিন পরে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া কঠিন হবে, সেটা কি তারা জানেন না? জানেন আর তাই তো সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাসে নারী যাত্রীদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি তদন্তনাধীন। প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি৷ তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’
দুই থানার ঠেলাঠেলিতে বাস ডাকাতির তিনদিন পর মামলা হলে বিষয়টা এমনই হবে। বাসটির চালকসহ আটকদের জামিনে মুক্তি এবং সময়মতো মামলা না নেওয়া এসব নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশ, প্রশাসন তথা সরকারের সমালোচনা চলছে।
সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে অনবরত ধর্ষণের নানা খবর আসছে। দুই বছরের কন্যা থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী কেউ বাদ যাচ্ছেন না। পাশাপাশি গণপিটুনির সাথে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে গণধর্ষণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এরমধ্যে ১৮টি গণধর্ষণের। ২০২৪ সালে ঘটেছে ৪০১টি ধর্ষণের ঘটনা, এর মধ্যে ১০৫টি গণধর্ষণ। এখানে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অনেক ঘটনাই থেকে যায় সংবাদের বাইরে।
কেন মানুষ এ ধরনের অপরাধ করে? যৌনতা যখন বিকৃতির পর্যায়ে চলে যায় তখন সেটাই ধর্ষণ। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও ক্ষমতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। এর চাইতেও বড় কথা হলো যে কোনো নারীকে নিজেদের ভোগের সামগ্রী মনে করা এবং সুযোগ পেলেই তাকে ভোগ করতে চাওয়া। এক্ষেত্রে সম্পর্ক, বয়স, স্থানকাল, নীতি-নৈতিকতা কিছু কাজ করে না। সমাজ একে প্রতিহত করে না, রুখে দাঁড়ায় না বরং ভয় পায়, লজ্জা পায় এবং ভিকটিম ব্লেইমিং করে। অপরাধীর বিচার হয় না। ফলে অপরাধ বাড়তেই থাকে।
ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর নুসরাত অনেক সাহস করে পুলিশের কাছে গিয়েছিল অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু ওসি সেই জবানবন্দি রসিয়ে রসিয়ে রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দিয়েছিল। এখন সেই ওসি ‘রাজনৈতিক হয়রানি’ বিবেচনায় মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন করেছে। সে যে অপরাধ করেছে, সরকারি চাকরির নিয়ম অনুযায়ী তার চাকরি চলে গিয়েছিল, এখন সে সেই চাকরি ফেরত চায়। আবেদনটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে মতামতের জন্য রয়েছে। দেখি কী মতামত পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও আসামি হারানো চাকরি ফেরত পেলে আর বলার কিছু থাকবে না।
শুধু ধর্ষণ বলি কেন, এদেশে নারী ঘরে-বাইরে সবসময় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অধিকাংশই প্রকাশিত হয় না, প্রকাশিত হলেও বিচারের আওতায় আসে না, বিচার হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে। তবে আইন সালিশ কেন্দ্রসহ অন্য মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো মনে করছে দেশে বর্তমানে নারী ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারীবিদ্বেষ সব বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগ নিয়ে নারীর প্রতি নিপীড়ন বেড়েছে। কমেছে নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কথা বলার সুযোগ।
আসক এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী জানুয়ারি মাসেই ১৪ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০২৪ এ হয়েছেন ৩১২ জন। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৩২ জন। এই তো সেদিন একজন নারী সরকারি কর্মকর্তা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে উনি রিকশায় করে যাওয়ার সময়, ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়ানো অবস্থায় পেছন থেকে পিঠে হাত দিয়ে খামচে ধরেছে এক দুর্বৃত্ত। যৌন হয়রানি করতে রাত বা সন্ধ্যা লাগে না, প্রকাশ্যে দিনদুপুরেই তা ঘটছে।
ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বাড়ছে, যেন কোনো প্রমাণ না থাকে। গবেষণা বলে, শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকার তুলনায় বস্তিতে ধর্ষণ বেশি ঘটে। শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা তুলনামূলক গ্রামাঞ্চলে বেশি। ধর্ষণ সংঘটনকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছিল। তবে এখন যৌন হয়রানিকারী ও ধর্ষকদের বয়স কমে আসছে। কিশোররাও এখন এই কাজে অংশ নিচ্ছে। ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটনের পর অনেক ক্ষেত্রে দোষীরা প্রচলিত শাস্তি এড়াতে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। সেই অবস্থা এখনো বলবৎ আছে।
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত আশপাশের লোকজন ভয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে অথবা ভিডিও করে। তাছাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করার পর সাক্ষীও পাওয়া যায় না। এমনকি মামলা তুলে নেওয়া ও মীমাংসার জন্য নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। যেহেতু সমাজে নারীবিদ্বেষ বাড়ছে, তাই নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের হয়রানি বাড়ছে।
আমরা ভেবেছিলাম রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে ধর্ষক ও দুর্বৃত্তরা মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং তারা রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করেছে। এখন দেখছি সময়ের ও নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও নারীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। নারীর চিৎকার আজও কেউ শুনতে পারছে না।
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম